বিতর্ক একটা কঠিন ব্যাপার। অল্প সময়ে ভারসাম্য না হারিয়ে, নিজেকে বা প্রতিপক্ষকে নয়, দর্শক-শ্রোতাকে বোঝাতে হবে। এ বিষয়ে সবাই পটু নন।
যিনি যত বড় জ্ঞানী অথবা বড় নেতা হোন, বিতর্কে হেরে যেতে পারেন। কমলা হ্যারিসের ব্যাপারে অনেকেই তাই ভেবেছিলেন। যাঁরা একেবারে তাঁর ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক, তাঁরাও সন্দিহান ছিলেন। মনে করা হচ্ছিল, দুজনের মধ্যে জেতার ফিফটি ফিফটি চান্স।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে একটা ভালো খবর থাকায় হ্যারিস সমর্থকেরা আরেকটু সন্দিহান ছিল। এক জরিপে দেখা যায়, ট্রাম্প পপুলার ভোটে এক পয়েন্ট এগিয়ে আছেন।
কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প সর্বশেষ প্রেসিডেনশিয়াল ডিবেটে অপ্রত্যাশিতভাবে ধরাশায়ী। এক জরিপে বলছে, ৬৩ ভাগ দর্শক মনে করেন বিতর্কে হ্যারিস জিতেছেন।
প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ দেখেছেন এই বিতর্ক। এর একটা প্রভাব তো রয়েছেই। অনেকের মতে, আজকের বিতর্কই নির্ধারণ করবে নভেম্বরের নির্বাচনে কে জিতবেন।
তাহলে হ্যারিস ক্যাম্পের জন্য খুবই খুশির খবর। এতই খুশির যে হ্যারিস ক্যাম্প তড়িঘড়ি আরেকটা বিতর্কের জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
এখন দেখা যাক ট্রাম্প এই খেলা, যে খেলায় তিনি নিজেকে খুবই দক্ষ মনে করতেন, সেটা আরেকবার খেলতে আগ্রহ প্রকাশ করেন কি না।
আজকের বিতর্কে ট্রাম্প অনেকগুলো ভুল তথ্য দিয়েছেন। তার কয়েকটির ক্ষেত্রে সঞ্চালকই বলতে বাধ্য হয়েছেন, এটি সত্য নয়। এগুলোর মধ্যে একটা এতই অযৌক্তিক যে সেটা সত্য তো দূরের কথা, ঘটাই সম্ভব নয়।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, আমেরিকায় কিছু স্টেটে সন্তান জন্মদানের পরও গর্ভপাত করা হয়। এ কীভাবে সম্ভব! জন্মের পরে শিশুকে মেরে ফেললে সেটাকে তো গর্ভপাত বলা হবে না। সেটা হবে হত্যা!
যা হোক, যাঁরা ট্রাম্পকে দীর্ঘদিন ধরে চেনেন, তাঁরা জানেন, এমন কথাবার্তা সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষেই বলা সম্ভব।
এ কথা শুনেই আমার একটা বহু পুরোনো এক পুঁথির পঙ্ক্তি মনে হলো, ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল’। ঘোড়ায় চড়ে যদি একজন একই সঙ্গে হেঁটে যেতে পারে, তাহলে হয়তো শিশুর জন্মের পরেও অ্যাবরশন সম্ভব।
আরও কতগুলো ব্যাপার ট্রাম্পের পক্ষে যাবে না। যেমন তিনি বলছেন, অবৈধ অভিবাসীরা ওহাইওর স্প্রিংফিল্ড শহরে মানুষের পোষা কুকুর-বিড়াল খেয়ে ফেলছে। এই অভিবাসী যদি স্প্যানিশরা হন, যেটা তিনি দাবি করছেন, তাহলে তো সবাই জানে, তাঁরা তো কুকুর-বিড়াল খান না!
অযথা কিছু মানুষকে অত্যন্ত খারাপ হিসেবে দেখাতে গিয়ে তিনি অবান্তর একটা প্রসঙ্গ টেনেছেন। এ ক্ষেত্রেও সঞ্চালক বলেছেন, এ ঘটনা সত্য নয়।
তখন আমার সেই পুঁথির পরের পঙ্ক্তির কথা মনে হলো। ‘কিছু দূর গিয়া মর্দ রওয়ানা হইল’।
তাঁর আরেকটা বড় বক্তব্য ছিল, অন্য দেশে, যেমন ভেনেজুয়েলাতে অপরাধ কমে যাচ্ছে। কারণ সেখান থেকে অপরাধীরা সব আমেরিকায় চলে আসছে। এ ধরনের সব খোঁড়া এবং অবান্তর যুক্তি তাঁর। অনেকটা গুজবের মতো। তিনি এমনকি কমলা হ্যারিস ইন্ডিয়ান নাকি কৃষ্ণাঙ্গ, এই সস্তা এবং বর্ণবাদী বিষয় নিয়ে আজকের বিতর্কে পানি ঘোলা করতে চেয়েছেন।
সেখানেও হ্যারিস সুন্দরভাবে বিষয়টাকে ঘোরাতে পেরেছেন, কাদা মাখামাখির মধ্যে না গিয়েই। সেই সুযোগে হ্যারিস বলে ফেললেন, বারাক ওবামা জয়ী হওয়ার পরে এই ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, বারাক ওবামার জন্ম আমেরিকায় হয়নি। এ বিষয়টা প্রমাণ করার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে বড় ধরনের বা ভালো কোনো পরিকল্পনা নেই, পলিসি নেই, সেটা পরিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন কমলা হ্যারিস।
তাঁর অন্যান্য দুর্বলতা, যেমন আইন ভঙ্গ করার কারণে অসংখ্য মামলা ঝুলছে তাঁর বিরুদ্ধে, তাঁর কাছের কোনো কর্মকর্তা বেশি দিন তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পারেন না, এমনকি কয়েক দিন পরেই তাঁর বিরুদ্ধে তাঁর কাছের লোকেরাই অভিযোগ করেন, তিনি বিভাজনের চেষ্টা করেন, ন্যাটোর প্রতি তাঁর কোনো অঙ্গীকার নেই, এসব খুব ভালোভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন হ্যারিস।
প্যালেস্টাইন ইস্যু হ্যারিসের জন্য কঠিন ছিল, যেহেতু তাঁর দল বর্তমানে ক্ষমতায়। সব দোষ অবশ্যই তাঁর ঘাড়ে বর্তায়। সেখানেও তিনি টু স্টেট সলিউশনের কথা বলেছেন। মোটামুটি বিষয়টাকে সামলাতে পেরেছেন।
যিনি আর প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নন, কিন্তু ট্রাম্প এখনো প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে শত্রু হিসেবে ভুলতে পারেননি। বারবার বাইডেনের কথা টেনে আনছিলেন। এই বিষয়টিও কমলা হ্যারিস পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
শুধু পলিসি বিষয়ে নয়, কে কী করেছেন সে বিষয়গুলোর বাইরেও ট্রাম্পের যে মানসিক গঠন, তাঁর যে ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি, সেটাও কিছুটা বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন কমলা হ্যারিস, ভব্যতার বাইরে না গিয়েই।
সবচেয়ে ভালো যেটা করেছেন, তা হলো তিনি যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ্য, মার্কিন জনগণের সামনে তা বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে প্রফেসর এলেন লিখম্যানকে ‘নস্ট্রাডমাস’ মনে করা হয়। গত ১০টি নির্বাচনের নয়টির ক্ষেত্রে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হয়েছে। যেটি হয়নি, সেটি কোর্টে গিয়েছিল। আলগোর যদি জর্জ ডব্লিউ বুশের (জুনিয়র বুশ) বিরুদ্ধে ভোট রিকাউন্টে যেতেন, তাহলে তিনি জিতে যেতে পারতেন বলে অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত। সেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, এবার জিতবেন কমলা হ্যারিস।
এই মাত্র টেলর সুইফটও বিতর্ক দেখার পরপরই ঘোষণা দিলেন, তিনি বমলাকে ভোট দেবেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রফেসর এলেন লিখম্যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিষয়ে আবারও সঠিক হতে যাচ্ছেন।
আপনার মতামত জানানঃ