ইন্টারনেট ব্যবহারে বিঘ্ন ঘটছে পাকিস্তানে। দেশটিতে ইন্টারনেট সচল থাকলেও এর গতি কম। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। তবে, কেন এমন হচ্ছে–এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি পাকিস্তান টেলিকমিউনিকেশন অথোরিটি (পিটিএ)। দেশটিতে রাজনৈতিক উত্তেজনা চলছে, অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থা। এ অবস্থায় এভাবে ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়ার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। দেশটিতে বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে না তো?
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি বাংলাদেশে বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। প্রথমে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। পরে বন্ধ করে দেওয়া হয় ব্রডব্যান্ড পরিষেবাও। একপর্যায়ে চাপে পড়ে জুলাইয়ের শেষদিকে চালু হয় ইন্টারনেট। তবে, এর মধ্যেই আন্দোলন বাড়তে থাকে। একসময় সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।
ছাত্র-জনতার সেই আন্দোলনে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। ছাড়তে হয় দেশ। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনও বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাঈদ আহমেদ পলকের মৌখিক নির্দেশে মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট শাটডাউন করা হয়েছিল বলে উঠে এসেছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে।
সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে বলছে, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের একটি বন্দরনগরীতে চালু হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এটি নির্মাণে সরাসরি চীন যুক্ত। দুই দেশের অর্থনৈতিক করিডরের অংশ হিসেবেই এটি বানানো হয়েছে। কিন্তু এই এলাকার অনেকেই প্রকল্পটির বিরোধিতা করছেন। সম্প্রতি এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভও দেখা গেছে।
এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানবাধিকার সংস্থা বেলুচ ইয়াকজেহতি কমিটি (বিওয়াইসি) বলছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয়দের সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে। নিজেদের অর্থনীতি ধ্বংসের পায়তারা চলছে। এ ছাড়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে সরকার। এ জন্য সবাই রাস্তায় নেমেছে।
বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটাসহ বিভিন্ন এলাকায় গত জুলাই থেকেই রাস্তায় নামছে জনতা। সংবাদমাধ্যম দ্য পিনাকল গ্যাজেট বলছে, এই জনতার ওপর নিরাপত্তাকর্মীরা বেশ কয়েকবার চড়াও হয়েছে বলে অভিযোগ। গুলিতে নিহত হয়েছে অন্তত ৯ জন। তবে, এসব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছে প্রশাসন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলছেন, এই আন্দোলনে দুষ্কৃতিকারীরা জড়িত।
এদিকে, ডন ও জিও নিউজসহ পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম বলছে, দেশটিতে গতির কারণে গ্রাহকদের ইন্টারনেট পরিষেবা পেতে সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে কিছু অঞ্চলে মোবাইল ডেটা ব্যবহার করার সময় বেশি সমস্যা হচ্ছে। ইন্টারনেট ব্যাঘাতে শুধু নাগরিকদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে না, বরং অর্থনৈতিক ক্ষতিও হচ্ছে ব্যাপক। এ কারণে ই-কমার্স এবং রাইড শেয়ার পরিষেবাসহ বেশ কয়েকটি অনলাইন ব্যবসা সীমিত হয়ে পড়েছে।
পাকিস্তান সরকার জাতীয় নিরাপত্তার উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ব্লক করে। কিন্তু ব্যবহারকারীরা এখনো ভিপিএন (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) ছাড়া এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি ব্যবহার করতে পারছে না।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম পাকিস্তান অবজারভার জানিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপের বিভ্রাটের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। এতে ব্যক্তি এবং ব্যবসা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নেটিজেনরা বলছেন, সরকার ইন্টারনেট বিভ্রাট ঘটিয়ে কেবল যোগাযোগকে বাধা দিচ্ছে না। তারা মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করছে।
ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সেবায় বিঘ্ন ঘটার বিষয়ে মুখে যেন কুলুপ এঁটেছে পাকিস্তান সরকার। দেশটির টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (পিটিএ) কাছ থেকে এ বিষয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ডিজিটাল জার্নালিজম নিয়ে শঙ্কার জেরে গত মাসে পাকিস্তানে একটি ফায়ারওয়াল ট্রায়াল দেওয়া হয়। এরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন অ্যাপগুলো চালাতে সমস্যায় পড়েন ব্যবহারকারীরা। গত মাসে সরকারি কর্মকর্তারা জানান, ফায়ারওয়াল ট্রায়াল শেষ হওয়ার পরে ইন্টারনেটের গতি স্বাভাবিক হবে।
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ডটকম বলছে, সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বলা না হলেও এ নিয়ে মন্তব্য করেছে দেশটির ওয়্যারলেস অ্যান্ড ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব পাকিস্তান (ডব্লিউআইএসপিএপি)। তারা বলছে, নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়াতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। এমনটাই বলেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শাহজাদ আরশাদ।
এমন এক সময় ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হলো, যখন সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, দেশটির বর্তমান সরকারের হাতে আর মাত্র দুই মাস রয়েছে। এর বেশিদিন টিকবে না।
সম্প্রতি কারাগারে থেকেই সাংবাদিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে কথা বলার সময় এই মন্তব্য করেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতা ইমরান খান। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম পাকিস্তান টুডে ও সামা টিভির প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা যায়। ইমরান খান বলেন, ‘আমি কারাগারে থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করছি, এই সরকারের হাতে মাত্র দুই মাস আছে। বর্তমান সরকার প্যাচপেচে কাদার মধ্যে পড়েছে।’
আবারও ক্ষমতায় আসার আশাবাদ ব্যক্ত করে ইমরান খান বলেন, ‘আমার হাতে তো অনেক সময় আছে। কিন্তু তাদের হাতে সময় নেই। তারা তো বোকা, কিছুই বুঝতে পারছে না।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলন, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ জারি—এসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। এর মধ্যে একটি লক্ষণ দেখা গেল পাকিস্তানেও। দেশটিতে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এখানেও মূলে রয়েছে চীন ইস্যু। বেলুচিস্তানে চলমান আন্দোলনের যে ধরন এবং তার সাথে ইন্টারনেট পরিষেবা বিঘ্নিত হওয়ার যে যোগ, দুই মিলে বিশ্লেষকদের চোখ বাংলাদেশের সদ্যবিগত ঘটনাপ্রবাহের দিকে। এই একই প্রবণতা কিছুটা ভারতেও দৃশ্যমান হচ্ছে। তবে তা নিয়ে এখনই উপসংহারে আসার সুযোগ নেই।
আপনার মতামত জানানঃ