মানুষ ইতিমধ্যে মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের ছবি তুলেছে। তুলেছে বহুদূর কৃষ্ণগহ্বরের ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্তের ছবি। গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রের ছবি তোলা তো জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে নিত্যদিনের ঘটনা। তাই ‘মিল্কিওয়ের ছবি কীভাবে তোলা হলো’—এরকম প্রশ্ন সহসা আমাদের মাথায় আসে না। কিন্তু প্রশ্নটা মাথায় এলে এবং খানিকটা ভাবলেই টের পাওয়া যাবে, জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
চাইলে একটু থেমে ভেবে নিতে পারেন আপনি। তবে সমস্যাটা ভালোভাবে বুঝতে হলে একটা উদাহরণ সহায়ক হতে পারে। চিন্তা করুন, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন একটা বনের ভেতরে। চারদিকে গাছপালা। এই বনের ছবি কীভাবে তুলবেন? ছবি তো তুলতেই পারবেন—সেটা বনের ভেতরের ছবি। কিন্তু বাইরে থেকে গোটা বনটা কেমন—এই ছবি তোলার উপায় কী? একইভাবে, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ভেতরে থেকে আমরা মিল্কিওয়ের ছবি তুললাম কীভাবে?
কেউ কেউ বলতে পারেন, যেভাবে পৃথিবীর ছবি তোলা হয়! কিন্তু পৃথিবীর ভেতর থেকে গোটা পৃথিবীর ছবি তুলিনি আমরা। সে জন্য মহাকাশে পাঠানো স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ এবং বিভিন্ন নভোদুরবিনের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। অ্যাপোলো মিশনের নভোচারীরা চাঁদে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর ছবি তুলেছেন। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে তোলা হয়েছে আমাদের গ্রহটির অনেক ছবি। কিন্তু মিল্কিওয়ের বাইরে আমরা কোনো মহাকাশযান পাঠাতে পারিনি। মিল্কিওয়ে তো বহুদূরের ব্যাপার, সৌরজগতের সীমা ছাড়িয়ে গেছে কেবল দুই ভয়েজার নভোযান—ভয়েজার ১ ও ভয়েজার ২।
তা, কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করতেই পারেন, মিল্কিওয়ের বাইরের গ্যালাক্সিগুলোর ছবি কীভাবে তুলি আমরা? বিষয়টা একদম সরল করে বললে, আলোর গতি সসীম। সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার। বহুদূর গ্যালাক্সি বা নক্ষত্র থেকে আলো এসে পৌঁছায়, সেই আলো ধরা পড়ে দুরবিনে। সেখান থেকেই পাওয়া যায় সেসব বহুদূর মহাজাগতিক বস্তুর ছবি। এর পেছনে পদার্থবিজ্ঞানের নানা বিষয় আছে, আছে আপেক্ষিকতার শক্ত প্রমাণ ‘মহাকর্ষীয় লেন্সিং’; তবে এসব নিয়ে এ লেখায় আমরা আলোচনা করব না। সরলভাবে বললে, মূল বিষয় ওটুকুই।
সমস্যাটা তো বুঝতেই পারছেন তাহলে। আমরা আছি মিল্কিওয়ের ভেতরে। আর এর বাইরে কোনো নভোযান, দুরবিন বা মানবনির্মিত কোনো বস্তু পাঠানো যায়নি। তাহলে বাইরে থেকে মিল্কিওয়ের ছবি তোলা হলো কীভাবে? উত্তরটা খুব সহজ: বাইরে থেকে আসলে মিল্কিওয়ের ছবি তোলাই হয়নি। তাহলে প্রশ্ন আসে, আমরা মিল্কিওয়ের যে ছবি দেখি, বেশ কিছু সর্পিল বা বাঁকানো বাহুর একটা গ্যালাক্সি—কোত্থেকে এল এই ছবি? সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন হিসেবে মাথায় উঁকি দেবে আরেকটি বিষয়: মিল্কিওয়ের আকৃতি কেমন, সেটা কীভাবে জানলাম আমরা?
আলোর বর্ণালির বিষয়টা হয়তো জানেন। হয়তো জানেন বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর কথা। আলো একধরনের তড়িৎ-চুম্বক তরঙ্গ। এর কিছু অংশ কেবল দেখি আমরা। মোটামুটি ৩৮০-৭০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আমরা দেখতে পাই। একসময় বিজ্ঞানীরা এই দৃশ্যমান আলোর বাইরের আলোগুলোর কথা জানতেন না। তাই ১৭ শতকে প্রথম বিজ্ঞানী উইলিয়াম এবং ক্যারোলিন হার্শেল যখন মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলোর মানচিত্র তৈরির উদ্যোগ নেন, তখন যে ছবিটা পাওয়া যায়, আজ আমরা জানি, সেটা যথার্থ ছিল না। তবে এ উদ্যোগ ছিল নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কারণ, তাঁরা সে কালের সর্বাধুনিক টেলিস্কোপে চোখ রেখে তারা গুনে গুনে এ মানচিত্র তৈরি করেন।
সমস্যা হলো, সৌরজগতের বাইরের বেশির ভাগটাই ধূলোর মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে। দৃশ্যমান আলোয় দেখা যায় বিশাল মিল্কিওয়ের কেবল সামান্য কিছু নক্ষত্র। কিন্তু এ পরিস্থিতি বদলে যায়, যখন মানুষ জানতে পারে বর্ণালির অন্যান্য আলোর কথা। এসব আলো—বলা উচিৎ তড়িৎ-চুম্বক তরঙ্গ—আমাদের চোখে স্বাভাবিকভাবে ধরা দেয় না। যেমন বেতার তরঙ্গ, অবলোহিত আলো ইত্যাদি। মজার বিষয় হলো, ধূলোর মেঘে দৃশ্যমান আলো আটকে যায় ঠিকই, তবে অবলোহিত বা বেতার তরঙ্গ এর মধ্য দিয়ে চলে যেতে পারে। এভাবে আমাদের সামনে খুলে গেল ধুলোয় ঢাকা নক্ষত্রগুলোকে দেখার পথ। অবলোহিত ও বেতার টেলিস্কোপে পাওয়া গেল বিশাল মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলোর খোঁজ।
এ যেন—বনের ভেতরে দাঁড়িয়ে একটা পর্দার জন্য অনেক গাছ দেখতে না পাওয়ার মতো। সেই পর্দা উঠে গেল, ভেতর থেকে এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি বনের সব গাছপালা। এসব তারাকে হিসাবে নিয়ে মানচিত্র বানালেন বিজ্ঞানীরা। নক্ষত্রের ঘনত্ব, কীভাবে ছড়িয়ে আছে—এসব হিসাব থেকে বুঝতে পারলেন, মিল্কিওয়ে আসলে খুব স্বাভাবিক ধরনের গ্যালাক্সি। নিতান্ত সাধারণ। মহাবিশ্বে এরকম গ্যালাক্সি অনেক আছে। ইংরেজিতে যাকে বলে, রেগুলার গ্যালাক্সি।
আমরা জানি, এসব রেগুলার গ্যালাক্সি কেমন হয়। সর্পিল। এগুলোর অনেকগুলো বাহু থাকে। চারপাশের নক্ষত্রদের ঘনত্ব, কীভাবে ছড়িয়ে আছে—এসব হিসাব থেকে আমরা বুঝতে পারি মিল্কিওয়ের বাহুগুলো কেমন। এই হিসাব ধরে, অন্যান্য রেগুলার গ্যালাক্সির সঙ্গে তুলনা করে শিল্পীরা এঁকেছেন মিল্কিওয়ের ছবি। সিমুলেশন করা হয়েছে। আবার একইরকম অন্য রেগুলার গ্যালাক্সির ছবিও ব্যবহার করা হয়েছে এ ক্ষেত্রে।
তবে এ সবই আসলে আমাদের অনুমান। আমাদের জ্ঞানের পরিধি, যৌক্তিক অবকাঠামো এবং বৈজ্ঞানিক হিসাব-নিকাশ মেনে শিল্পীর কল্পনা। সেই কল্পনা, কম্পিউটার সিমুলেশন মিলেঝিলে মিল্কিওয়ের যে ছবি দাঁড়িয়েছে, তাই দেখি আমরা।
ঠিক ধরেছেন, অ্যান্ড্রোমিডার মতো প্রতিবেশী গ্যালাক্সি বা কয়েক শ কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সির ছবি তোলা হলেও নিজেদের গ্যালাক্সির কোনো ছবি আমরা আজও তুলতে পারিনি। হয়তো কখনোই পারব না।
আপনার মতামত জানানঃ