মধ্যপ্রাচ্যে লড়াই-সংঘাতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এত দিন ঢাক ঢাক গুড় গুড় চললেও এবার ছেড়ে কথা বলেনি ইরান। দেশটি সরাসরি ইসরায়েলের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়েছে। এ হামলার রাজনৈতিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে এবং অর্থনৈতিক প্রভাবও নিছক অল্প নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
হামাস গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েলে হামলা চালালে প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েল ফিলিস্তিনে রীতিমতো গণহত্যায় মেতে ওঠে। এর প্রতিবাদে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে চলাচলকারী বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা শুরু করে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন করে সরবরাহ সংকট সৃষ্টি হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতেও জাহাজে পণ্য পরিবহনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
এতে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও যে প্রভাব পড়বে, তা বলেই দেওয়া যায়। বিশেষ করে লড়াই-সংঘাতের জেরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে গেলে বাংলাদেশও সমস্যায় পড়বে।
ইরান ও ইসরায়েলের সংঘাতের কারণে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে তেল ও গ্যাসে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুই দেশের মধ্যকার লড়াই-সংঘাতের চূড়ান্ত পরিণতি হতে পারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি। ফলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি আবারও বাড়তে পারে।
তবে এখন পর্যন্ত তেলের দামে সে রকম প্রভাব পড়েনি। গত সোমবার বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ১ শতাংশ কমেছে। গতকাল বুধবারও ডব্লিউটিআই ক্রুড ও ব্রেন্ট ক্রুডের দাম শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ কমেছে।
এদিকে বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরানের তেলক্ষেত্রগুলোতে হামলা হলে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ১০০ মার্কিন ডলার, আর হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে তা ১২০ থেকে ১৩০ ডলারে উঠে যাওয়ার শঙ্কা আছে।
সোনার দাম এমনিতেই ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা আরও বাড়লে সোনা কেনার প্রতি মানুষের আকর্ষণ আরও বেড়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, বিপদের সময় মানুষ ‘সেফ হ্যাভেন’ বা ‘নিরাপদ বিনিয়োগ’খ্যাত মাধ্যম হিসেবে সোনার প্রতিই আকৃষ্ট হয়। এটি চিরন্তন সত্য।
তবে ইসরায়েলের ওপর ইরানের হামলার পর তাৎক্ষণিকভাবে সোনার দাম অতটা বাড়েনি। হামলার পরদিন সোনার দাম আউন্সপ্রতি শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। গতকাল এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সোনার দাম বেড়েছে শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় একদিকে সোনার দাম বেড়েছে, অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে তিন দিন ধরে শেয়ারবাজারের মূল্যসূচক কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির হার টানা তিন মাস ধরে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশটিতে নীতি সুদহার হ্রাসের সম্ভাবনা কমেছে।
তার ওপর ইসরায়েল হুমকি দিয়ে রেখেছে, ইরানের প্রায় ৩০০টি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাব দেবে তারা। ফলে গতকাল এশিয়ার প্রায় সব দেশে শেয়ারের মূল্যসূচক কমেছে। যুদ্ধের আশঙ্কায় গত তিন দিনে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতের বাজারে ১৬ হাজার কোটি রুপির বেশি মূল্যের শেয়ার ছেড়ে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বাড়ছে।
ইসরায়েল-ইরান সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কায় ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি ভ্রমণ-পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া আকাশপথে বিমান ও জলপথে জাহাজ চলাচল ব্যাহত হতে পারে।
ইসরায়েলে গত শনিবার ইরানি হামলার সময় এবং এরপর ইরান, জর্ডান, ইরাক, লেবানন, ইসরায়েলসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ সাময়িকভাবে আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়। পরে আকাশসীমা খুলে দেওয়া হলেও নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
অনেক বিমান সংস্থা বিরোধপূর্ণ অঞ্চল এড়িয়ে বিকল্প পথে চলাচলের কথা ভাবছে। ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইটগুলো ইরানের আকাশসীমা থেকে কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, সৌদি আরব ও মিসরের দিকে বিমান ঘুরিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছে।
কিন্তু বিমানের পথ পরিবর্তনের অর্থ হলো, ঘুরপথে বিমান চলাচল। সেটা হলে বিমান চালনায় জ্বালানি খরচ বেড়ে যাবে। এর মানে বিমানভ্রমণ আরও ব্যয়বহুল হবে। এতে ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে বিমানে ভ্রমণের ভাড়া বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
আপনার মতামত জানানঃ