রাজধানীতে মাদক সেবন ও ব্যবসায়ের সঙ্গে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা দিনদিন বেড়েই চলছে। গত বুধবার(১৩জানু) পুলিশের অভিযানে দুই পুলিশ কনস্টেবল ফেনসিডিলসহ ধরা পড়েন। তারা হলেন- পুলিশের দাঙ্গা দমন বিভাগের কনস্টেবল সুয়েজ খান ও মো. আসাদুজ্জামান। বুধবার রাতে ফকিরাপুল, ডেমরা ও খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়া এলাকায় ধারাবাহিকভাবে এ অভিযান চালানো হয়। এ সময় তাদের দুই সহযোগীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৪৫ বোতল ফেনসিডিল ও ১টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
জানা যায়, বুধবার রাত আটটার পর গোপন খবরের ভিত্তিতে মতিঝিল থানার পুলিশ ফকিরাপুলে অভিযান চালিয়ে ১৫ বোতল ফেনসিডিলসহ পুলিশ কনস্টেবল সুয়েজ খানকে গ্রেপ্তার করে। পরে তার তথ্যের ভিত্তিতে খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়া থেকে আরেক পুলিশ কনস্টেবল আসাদুজ্জামানকে (২৭) ও তার সহযোগী লিজা বেগমকে পাঁচ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার করে। পরে তাদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ভোর পাঁচটার দিকে ডেমরায় অভিযান চালিয়ে শিবলি আহমেদকে ২৫ বোতল ফেনসিডিল, ১টি রিভলবারসহ গ্রেপ্তার করে। এসব ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি, খিলগাঁওয়ে একই আইনে আরেকটি এবং ডেমরা থানায় অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য আইনে দুটি মামলা করা হয়।
মতিঝিল থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে হওয়া মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কাওছার আহমেদ বলেন, মাদকদ্রব্য আইনের একটি মামলায় চারজনকে সাত দিন করে রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠানো হয়। শুনানি শেষে আদালত তাদের প্রত্যেকের চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
শুনানি শেষে আদালত তিনজনের প্রত্যেককে চারদিনের এবং লিজাকে একদিনের রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন। রিমান্ডের শুরুতে শুক্রবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদে তারা মাদক সিন্ডিকেটের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন।
তারা জানান, দুই পুলিশ কনস্টেবলের বাড়ি দিনাজপুরে। ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় বাড়ি হওয়ায় তারা ফেনসিডিল ঢাকায় এনে পাইকারি বিক্রি করত। পাশাপাশি খুচরাও বিক্রি করেন। ভারত থেকে প্রতি বোতল ফেনসিডিল ঢাকায় আনতে তাদের ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা খরচ হতো। পাইকারি ১০০০ হাজার ও খুচরা এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকায় ফেনসিডিল বিক্রি করা হতো। তারা মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়িতে যেত। বাড়ি থেকে ফেরার সময় ফেনসিডিলের চালান নিয়ে তারা ঢাকায় আসত। পুলিশের ব্যাগে করেই তারা ফেনসিডিল আনত। পুলিশ সদস্য হওয়ায় তাদের ব্যাগ কেউ তল্লাশি করত না বলেও জানায় তারা।
আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের নির্দেশে সম্প্রতি পুলিশে ডোপ টেস্ট শুরু হয়। এরই অংশ হিসাবে সুয়েজ খানের টেস্ট করা হয়। ডোপটেস্টে পজিটিভ আসার পর ২০ অক্টোবর থেকে সুয়েজ অফিসে গরহাজির বলে মতিঝিল থানা পুলিশকে তিনি জানিয়েছেন।
তিনি জানান, ডোপটেস্টে পজিটিভ হওয়ার পরই বুঝতে পারেন তার চাকরি থাকবে না। তাই অফিসে অনুপস্থিত থেকে তিনি জোরালোভাবে মাদক ব্যবসা শুরু করেন। মাদক ব্যবসাকেই জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস হিসাবে মনে করেন। গ্রেপ্তার আসাদুজ্জামান জানান, তিনি পুলিশ ক্রিকেট টিমের একজন সদস্য। এ মাদক সিন্ডিকেটের তিনিই নেতৃত্ব দেন।
অস্ত্র ও ফেনসিডিলসহ গ্রেফতার শিবলী মাদক ব্যবসার পাশাপাশি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকে তিনি মাদক ব্যবসার ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেন।
পুলিশের নেতৃত্বাধীন এ মাদক চক্রকে কীভাবে শনাক্ত করা হলো জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, এক সোর্সের মাধ্যমে প্রথমে বিষয়টি জানতে পারি। পরে ওই সোর্সের মাধ্যমে ক্রেতা সেজে ফেনসিডিল কেনার প্রস্তাব দেই। ১৫ বোতল ফেনসিডিল কেনার জন্য ১৫ হাজার টাকা দাম নির্ধারণ করি।
ছদ্মবেশধারী পুলিশের কাছ থেকে লিজা ওই টাকা নেন। পরে সুয়েজ ফেনসিডিল সরবরাহ করেন। এ সময় লিজা ও সুয়েজকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর সুয়েজ জানান, তার ব্যাচমেট আসাদুজ্জামান এ চক্রের মূলহোতা। আসাদুজ্জামানের কাছে আরো ফেনসিডিল মজুদ আছে। এরপর আসাদুজ্জামানকে ফেনসিডিলসহ তার খিলগাঁও নন্দীপাড়ার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসাদুজ্জামানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডেমরায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও মাদকসহ শিবলীকে গ্রেফতার করা হয়।
বৃহস্পতিবার মতিঝিল থানায় করা মামলায় বাদী এসআই সফিকুল ইসলাম আকন্দ উল্লেখ করেন, ১৩ জানুয়ারি রাত ১০টার দিকে ফকিরাপুলের জি-নেট টাওয়ারের সামনের রাস্তায় কৌশলে অভিযান চালিয়ে সুয়েজ খান ও লিজা বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৫ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী- ওইদিন রাত দেড়টার দিকে খিলগাঁওয়ের ৬৭ নম্বর মধ্য নন্দীপাড়ার বাসায় অভিযান চালিয়ে আসাদুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার শয়নকক্ষ থেকে পাঁচ বোতল ভারতীয় ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়।
মামলায় বলা হয়, তিন আসামির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সহযোগী শিবলীর কাছে বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল ও অস্ত্র মজুদ রয়েছে। পরে রাত আড়াইটার দিকে ডেমরা থানার রাজাখালী নবাব আলী মুন্সীবাড়িতে অভিযান চালিয়ে শিবলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার হেফাজত থেকে একটি খালি ম্যাগাজিনসহ ফাইবারের বাটযুক্ত সিলভার রংয়ের পিস্তল উদ্ধার করা হয়। পাশাপাশি তার শয়নকক্ষের ওয়ারড্রব থেকে ২৫ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, মাদক চোরাচালান ও ব্যবসায়ের সঙ্গে পুলিশের জড়িয়ে পড়াতে সমাজে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। লোকজনের নিকট পুলিশ ভরসা হারিয়ে এখন মাদক সিন্ডিকেট ও সন্ত্রাসী সংগঠন ভিন্ন অন্যকিছু নয়। মাদকের সঙ্গে একেরপর এক পুলিশের জড়িয়ে পড়াতে এক রকম আতঙ্ক বিরাজ করছে সমাজে। পুলিশের আইজিপি নিয়মিতই বলে যাচ্ছেন মাদকের সঙ্গে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা থাকলে কোনো ছাড় নেই, যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েই শুদ্ধি অভিযান চালাতে চান তিনি। অথচ মাদক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পুলিশ জড়িয়ে পড়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন লোকজন। নিজেদের শুদ্ধ করতে পারছেন না যে বাহিনী, অন্যান্য অপরাধ পুলিশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে, লোকজন এমন ভরসা হারিয়ে ফেলেছেন বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৬
আপনার মতামত জানানঃ