আজ ১৪ জানুয়ারি বাংলা নাটকের গৌড়জন-খ্যাত নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের ১৩তম মহাপ্রয়াণ দিবস। মহান এই বাঙালিকে নতুন করে চিনিয়ে দেয়ার কিছু নেই। বাংলানাটকে তিনি যুক্ত করে গেছেন মহাকাব্যিক বর্ণনাধর্মী স্বকীয়ধারা। পশ্চিমা নাট্য-আঙ্গিককে অস্বীকার করে কাজ করেছেন হাজার বছরের বঙ্গীয় জনপদের নিজস্ব শিল্পধারা প্রতিষ্ঠায়।
নাটকের জন্য তিনি কী না করেছেন। তার সারাটা জীবনই নাটকের জন্য উৎসর্গিত। নাটকে গানের ব্যবহার নিয়ে তিনি নতুন কিছু করার কথা ভাবতেন। তাই শুরু করেছিলেন আবহমান বাংলার লোকজরীতির অনুসন্ধান। বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ছুটেছেন লোক-নাট্যরীতির সন্ধানে। নিজের নাটকে সেসব প্রয়োগ করে বদলে দেন বাংলানাট্যের ধারা।
আশির দশকের মাঝমাঝি সময় থেকে তিনি গান লেখা শুরু করেন। নাটকের গান তো ছিলই। পাশাপাশি আরও অনেক গান লিখেছিলেন। তিনি গানকে বলতেন, কথাসুর। তার লেখা ১৫টি গান আজ এই আয়োজনে তুলে ধরা হলো। এই গানগুলোও সেলিম আল দীনের মতোই অনন্য, আমাদের চেনাজানা বাজারি গানের সঙ্গে যেন মেলে না…
১.
এই তো খানিক সময়
যাদু যাদুরে
দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে চলে যাবি
ভোরে নামবে কৃষ্ণ পক্ষ রাত।
যাদু যাদুরে।
তারপর মানবজন্মে কত ঋতু শস্য কর্তন
মাঠে মঠে সোনার শর্সে ফুল ঘন চাঁদ
তোর সাথে দেখা আর হবে না কখনো।
২.
কিছু চিত্র চোখে ভেসে যায় নৌকা
দৃশ্য তবু মন্ত্রপ্রতিম রঙ
টেনে নিয়ে যখন অরণ্যে
পাখি ও মৌমাছিদের চোখ
ভীম পলাশীর চোখে তাকায় গোধূলী
তখন যৌবনে কবির শ্রমণে নেমেছি
তরুণ পৃথিবী দেখি
নিত্য প্রিয় মুখ।
অনেক অনেক আগে ঝাঁকড়া চুলে
দেবদারু পাতা খসা দিন
মনে হলো ঘুরে আসি সর্বপ্রাণতার
গুপ্ত চলাচল।
অরণ্যের শীর্ষে শীর্ষে বাঁকা রোদ
আমার ছায়া পিঠ পিছন দীর্ঘ হয়েছে
সেও চলছিল ছায়াময় ভাষাহীন।
মনে পড়েই তো উৎসঙ্গের সেই দিন।
সহসা পথ নয়- বুক ফেটে ঘাসস্মৃতি
আনন্দ হারিয়ে গেলে নিরপেক্ষ সেই মুখ
যায় না সুখের দিকে। তবে সাঁঝ ঘনালেই শেষমেষ
এই অরণ্যভ্রমণে ভ্রুবিন্দুতে গেঁথে নেবো সাঁঝ তারা
দিন ফুরায়ে এলে অভীষ্ট দিন
তারার সংকেতে গান গেয়ে ওঠে কি না।
আজো সেই চিত্র দু’চোখে জাগিয়ে বসে থাকি
কিন্তু সুরে ॥
৩.
হায়রে আমার বালু ঘড়ি দিন
হায়রে আমার রাত্রি ঝরা মেঘ
হায়রে আমার লুপ্তদিনের ভাষা ॥
ফেলে আসা দরোজাগুলো জানালাগুলো
ফেলে আসা নানা বরণ পুরাণ পিরান হায়রে
জং ধরা সেই থমকে যাওয়া নষ্ট ঘড়ির কাঁটা
হায়রে প্রথম প্রেমের নিবেদন ॥
সজল রঙিন পৃথিবী থেকে এতোটা দূর
এতোটা বিষাদ চন্দ্রহীনা রাত- হায়রে
কাঁদন বাউল গেয়েছিল এক বৃষ্টিঝরা
মাঘের ঘন বিষণ্ন রাত
ফেরে না রে ফেরে নারে ফেরে না
ও সেলিম ফেরে নারে ফেরেনারে ফেরে না ॥
৪.
তোমার মন ভালো নেই
ফুলেদের মন ভালো নেই
মেঘেদের মন ভালো নেই
তুমি অন্ধকারে শিউরে উঠ
বাতাসের দুঃখের গন্ধ পাও
জলে জলে চাঁদ ঝলে
তুমি মিথ্যে দুঃখ পাও।
এই সুরগুলি তবে তোমার সঙ্গী হোক
তোমার মুখের ত্বকে
কষ্টের ছায়া ততো মিলাক মিলাক
চাঁদের আলোর ক্ষণরে ॥
তোমার মন ভালো হোক
ফুলেদের মন ভালো হোক
মেঘেদের মন ভালো হোক
৫.
ফেলে এলাম ফেলে এলাম
সাদা মেঘে জল কল্লোল শঙ্খ বাতাস
ফেলে এলাম সূর্যকিরণ
বিচ্ছুরণের স্বর্ণকুহুক ॥
ফেলে এলাম নদীর জল
রৌপ্য শীর্ষ বাঁশের দোলা
তোমার মুখ বিচিত্র রং
ছায়াসন্ধি সন্ধ্যাতারা ॥
জীবনের নানা রঙের দিনগুলি পেরিয়ে এসে এক অনিশ্চিত অনন্তের সামনে দাঁড়িয়ে এ আমার অনিবার্য উচ্চারণ।
৬.
আহা হা হা আহা হা হা
পিঁপড়েরা যায় পিঁপড়েরা যায় পিঁপড়েরা যায় চলে
দলে দলে দলে দলে দলে
আহা হা হা আ হা হা হা আ হা হা হা
পিঁপড়েরা যায় পিঁপড়েরা যায় পিঁপড়েরা যায় চলে ॥
পদ্যবন্ধ বর্ণগুলো বোধের দিকে ভাবের দিকে
পিঁপড়ে চলে রে
প্রথম যুগের উদয় দিগঙ্গনের ভোরে
ও আমার পিঁপড়েরা যায় চলে
আসছে কালের ভবিদিনের দিকে
ও ও ও ও
ও আমার পিঁপড়েরা যায় চলে
দলে দলে দলে
গাম্ভারি ফুল গুচ্ছ গুচ্ছ
মধুকণার লোভে পিঁপড়েরা যায় চলে
বসন্তকাল শিমূল ফোঁটা পিঁপড়েরা যায় চলে
ফাল্গুনী রাত কোমল রাত্রি পিঁপড়ে চলে
পিছন পিছন ছেলে মেয়ে পিঁপড়ে চলে
আ হা হা হা আ হা হা হা আ হা হা হা
পিঁপড়েরা যায় চলে।
৭.
নিজের রুদ্ধশ্বাসের ভালোবাসা সমুদ্র কিনারে
কুলের চিবুক ভিজায়ে ফেনা
তা সে উঠুক যতো
ছোঁবে না তোমাকে
ঢেউয়ের চূড়ান্ত শীর্ষে শীর্ষে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠবে ঢেউ
তবু তা ছোঁবে না তোমাকে।
এই অন্ধ আহ্বান অন্ধের ভুল প্রেম
নিয়ে যাবে আরো কোন
গূঢ় তমস্রায় ইজিয়ান সমুদ্র কূলে
সেই কূলে কোন এক নিস্ফলরাতে অন্ধ হোমার কি
বাজায়েছিল যন্ত্র তার
পথের শেষ কোথায় বলে
আহা সেই কূলে বসে গীতবিতানের কবি
হয়েছিল কিনা অশ্রুক্ষরণ হায় ॥
৮.
এই আষাঢ়ের মেঘস্তরে ঢেউ উঠেছে
বাউল বাউল গন্ধ মেখে ঢেউ উঠেছে
হঠাৎ কোন অন্ধকার থেকে সে ভেসে এলো কণ্ঠ তোমার
সুর ভরা সুর
বজ্রঝিলিক সূতায় বোনা সুরভরাস্বর
ঝর ঝর ঝর বৃষ্টি ঝরে
হঠাৎ কখন ঝর ঝর ঝর
শ্রাবণ এলো ভাদ্র গেল
কণ্ঠস্বরের চিহ্ন তবু রইলো লেগে
আমার কানে আমার গানে সুরভরাস্বর
আকাশ জুড়ে সুরভরাস্বর ॥
আমি অপ্রত্যাশিত স্বরে বিমূঢ় হয়েছিলাম ঈশ্বর কি মেঘস্তরের আভাসে আসেন আষাঢ়ে। শরতে শিউলি ফোটা- সমস্ত হত্যার রক্ত নদী সাঁতরে এই উপসাগরীয় কূলে- এক অখ্যাত কবির কণ্ঠে এই ভটিমা। তুমি কি গ্রহণ করবে না- যে কি না গ্রহের গ্রহণ- জলদহনকারী।
আশ্বিনের ওই সাঁঝতারাটি ঝকোমকো
তোমার আষাঢ় কণ্ঠস্বরের দ্যুতি
শিউলি দিনে চন্দ্রগন্ধী রাত
হেমন্তে যে কোন সোনাধান দেবে
ও তোমার সুর ভরাসুর
বজ্রঝিলিক সূতায় বোনা সুরভরাস্বর ॥
৯.
এই সূঁচশ্বাস এই বাঁকা বড়শি বাজনখে
মাংসত্বক গাঁথা হলো যদি
কোন দূর শূন্যে উষর আকাশে
উড়াল দিবিরে তুই
আমি তোর জন্মদিনের বসন বুনতে গিয়ে
বুনেছি কাফন
শাদা নির্ভুল শাদা
আ-হা-আ-হা।
হায়রে- কে কবে দেখেছে শিশু সকালের উপর
সন্ধ্যা ঝাঁপিয়ে পড়ে
রাত্রি ঝাঁপিয়ে পড়ে।
নিয়ে যায় মরণ সারস ডানায়
হায়…
আহা…
কোন দূর শূন্যে ঊষর আকাশে
উড়াল দিবিরে তুই ॥
১০.
আমি নদীর কাছে গিয়েছিলাম
নদী বললো না না না না
শুষ্ক চরে উড়িয়ে ধূলা বাওকুড়ানির খেলা
না না না না না ।
নদী তোমার কি নাম
ভাঙা কিনার ধূধূ চরে না মেলে উত্তর
চিৎকার করে ডাকলাম
নদী তোমার কী নাম।
শেষ বিকেলের রোদে
চিকিয়ে ওঠা ক্ষিনাঙ্গ সেই স্রোতে
আমার মুখ বহমান স্রোতের মতো
তবু নদীর কাছে গিয়েছিলাম।
কাশবন নেই বালিহাঁসের ঝাঁকবাঁধা গান নেই
তবু নদীর কাছে গিয়েছিলাম।
স্ফিত হও যদি নদী
তোমায় ভরা যৌবন দেব
দেব দেব দেব নদী যদি
আমার গলার সোনার হার তোমায় পরাবো
স্ফিত হও যদি নদী
আমি নদীর কাছে গিয়েছিলাম ॥
১১.
আমি যতোবার উড়াল মেঘেদের শরীর ছুঁতে চাই
দ্রুত ভেঙ্গে যায় ধাওন্ত গড়ন গঠন।
কিছু রঙ স্বপ্নের থেকে পাওয়া
কিছু রঙ বসন্ত দিবসের
জমা রেখে বসে থাকি
আকাশে নিমগ্ন চোখ ॥
ভাদ্র বিকাল রঙে রাঙা মঘেদের ঘর
বিলোপিত নীল আকাশ
স্বপ্ন গড়ার আগে সেইখানে
মেঘেদের ঘরবাড়ি
ভাঙচুর ভাঙচুর মিলায় হাওয়ায়।
আহা যৌবন ছোপোনো দিন
কত দ্রুত অপসৃত রোদালো ভাদ্র মেঘ
নামছে বিকাল আর ফুঁ দিচ্ছে সন্ধ্যা হাওয়ারা।
১২.
মৃত্যুর কোন অমোঘ ঠিকানায়
ওরা চলে যায়
ঐ পাখিটা শিষ দিচ্ছে গান গাইছে
উড়াল দিচ্ছে আকাশে
তারপর নামল সন্ধ্যা
সূর্য ডোবার কোন সে ঠিকানায়
ওরা চলে যায়।
গহন গহীন মরণারণ্যে ওরা চলে যায়
মরণ আঁধার খোঁড়ার ক্ষণে ওরা চলে যায়
মৃত্যুর কোন অচীন ঠিকানায় ॥
আমি এতো যে বসন্তের দূত
তবু কখনো কোন কোকিলকে হরিয়াল ঘুঘু
তিতির ময়ূর কিংবা গোখরো সাপ
মরতে দেখিনি।
মরণক্ষণ ঘনায়ে এলে
মৃত্যুর আগে ওরা কোথায় যায়
কোন সে ঠিকানায়
মৃত্যুর কোন অচিন ঠিকানায় ॥
কিন্তু হায় মানুষের চারপাশে
এতো যে অনর্থ আয়োজন
স্বজন শয্য অশ্রুপাত
হায় সুঁচ ও সিরিঞ্জও
সাদা কোট ঘন ঘন আসা যাওয়া দীর্ঘশ্বাস
মৃত্যুর সেই অজানিত নিঃস্বর ঠিকানায়
চলো চলে যাই ॥
১৩.
তোমার ঠোঁটের স্মৃতি উড়াল পাখি
দাঁড়াই এসে ঝরো এক ভাঙনমুখা নদীর কিনারে
তরঙ্গ রঙে ঢঙে ঢেউ খেলায়ে যায়
সে এক পাওয়া শূন্য পাওয়া
কিন্তু পাওয়া কৃষ্ণপক্ষ রাতে
সে চাঁদ দেখে আঁধারের দু’চোখ দেখে
মানুষ দেখে না।
এবার ছুটিতে আমি আমার গাঁয়ের বাড়িতে
কঙ্কাল শয়ণে শায়িত আমার মাকে
দেখতে গিয়েছিলাম
চারদিক ইটে ঘেরা মাঝখানে বনবিড়ালের
থাবায় হত পাখির পালক
মা মা শোন এই রোদন আমার
ঈশ্বর আমি এর হিসাব মিলাতে পারি না।
১৪.
আকাশ ও সমুদ্র অপার
তারো অধিক জীবনে জীবন এই শূন্যতা
শেষ নেই তার শেষ নেই
কত জন্ম কত মৃত্যু
পারায়ে পারায়ে যায় তার
শেষ নেই শেষ নেই ॥
মৃত্যুর সিথানে সিথান
কবরের পাশে কবর।
আকাশ রাত্রি ছোঁবে
দিন ছোঁবে সাঁঝ
শূন্যতার আবর্তন শেষ নেই তার।
ঘন অন্ধকারে মহা শ্মশান
বয়ে নিয়ে যাই পাঁজরের নিচে
হা হা চিৎকার তবু নিস্বরে
জলের প্রতিবিম্বতা ছুঁয়ে দেখেছি হায়
সে এক শূন্যতা।
১৫.
রাতের চাঁদের আলো
নিরেট চিবুকে তোমার
দোলাচল দোলাচল খেলা করে যায়।
মহুয়া বৃক্ষের তলে ঝরাপাতা
শাখাভরা কুঁড়ি শাদা ফুল
ঝরে টুশটাশ শিশির পাত
হাওয়ায় হাওয়ায় দোলাচল।
এইখানে আজ এই কথা
বলা যাবে কি না
তোমার অস্থিসন্ধির গন্ধে
ফুল ফুটেছে অজস্র অজস্র
শাদা কিন্তু বিচিত্র গন্ধী।
রাতের চাঁদের আলো
শিউরে উঠেছে শিরীষ অজস্র অজস্র
শাদা কিন্তু বিচিত্রগন্ধী
শিরীষ গাছের নিচে
এই কথা বলা যাবে কি না।
রাতের উড়াল হাঁস
প্রেম ও তোমার মুখ
একাকার একাকার।
১৬.
আমি মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন রাতে
পূর্ণ চাঁদের উদয়কালে
সন্ধ্যাবেলা দুহাত তুলে বলেছিলাম
প্রভু আমার মনে শান্তি বইয়ে দাও।
ঠিক সেই রাত্রেই নগর আক্রমণ হলো। হত্যা লুণ্ঠনে ভরে গেল প্রাচীন গুতদয়ারা।
ও তোমার করতলে এতো জল
প্রভু শান্তি বইয়ে দাও ॥
আঙ্গুলের ছাপ প্রার্থনা পল্লবে পল্লভ হয়ে
ঢেকে দিয়েছিল মুখ
প্রভু আমার এ মুখ ॥
সুপক্ক ডুমুর গাছের ছায় সেই প্রাচীন রাতে
জ্যোৎস্নালোকে আমার পিঠ পিছন ছিল
আকাশ প্রভু শান্তি বইয়ে দাও ॥
আপনার মতামত জানানঃ