ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা বসছে। এসব সিসি ক্যামেরা বসাতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনে এসব ক্যামেরার ফুটেজ দিতে হবে পুলিশকে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক চিঠি থেকে জানা গেছে, এই সিসি ক্যামেরা বসানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনারসহ সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ওই চিঠি থেকে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবরে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় নিজ উদ্যোগে সিসি ক্যামেরা বসানোর অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট ভবন ও জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে ওই সিসিটিভির ফুটেজ যাতে প্রয়োজনে নিকটস্থ থানা-পুলিশ পেতে পারে, সে বিষয়েও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। ওই চিঠিতে সই করেন মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব মোহাম্মাদ রাশেদ হোসেন চৌধুরী।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও ফুটেজ দেওয়ার বিষয়টি মানুষকে ঝুঁকিতেও ফেলতে পারে। কারণ, কোনো কোনো পুলিশ সদস্য ফুটেজ অসৎ উদ্দেশ্যেও কাজে লাগাতে পারেন। তাই ফুটেজ যেন অপব্যবহার না হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলেছে, নাশকতা, ছিনতাই, সন্ত্রাস, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়েছে। মোবাইল ফোন ছিনতাইকারী চক্রকেও বাগে আনা যাচ্ছে না। বিভিন্ন দপ্তর থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফাইলও চুরি হয়েছে। পুলিশের মাসিক অপরাধ সভায়ও বিষয়টি উঠেছে। কিন্তু বেশির ভাগ ঘটনাস্থলে বা আশপাশে সিসি ক্যামেরা না থাকায় বা ফুটেজ না পাওয়ায় অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। অপরাধীদের দমনে তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ খুব গুরুত্বপূর্ণ, যা অপরাধ রোধ ও অপরাধীদের ধরতে পুলিশকে বিশেষ সাহায্য করে। কিন্তু পুলিশ এই সাহায্য পাচ্ছে না। বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে ঊর্ধ্বতন মহলে জানানো হয়।
সূত্র বলেছে, কয়েক বছর আগে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মোড়ে অন্তত ৫০০ সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছিল। আরও ক্যামেরা স্থাপনের কথাও ছিল। কিন্তু বসেনি। এদিকে স্থাপিত সিসি ক্যামেরাগুলোর বেশির ভাগই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন অকেজো। ফলে এগুলো থেকে পুলিশ কোনো সাহায্য না পাওয়ায় অপরাধীদের ধরতে সমস্যায় পড়ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, গত বছর সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় ২৬১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি অনেক কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েবের মামলাও হয়েছে। কিন্তু এসব স্পর্শকাতর ঘটনার বেশির ভাগ স্থানে ও এর আশপাশে সিসি ক্যামেরা ছিল না। তাই ফুটেজ পাওয়া যায়নি। সেই মামলাগুলোর সুরাহা হচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহী রেঞ্জের একটি জেলার পুলিশ সুপার আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া তদন্ত করা যায় না, তা নয়। ওই তদন্ত নিখুঁতও হয়। তবে ক্যামেরার ফুটেজ থাকলে ঘটনা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার থাকে। সেই তথ্য-প্রমাণ আদালতে দাখিল করতে পারলে বিচারপ্রক্রিয়াও দ্রুত হয়। অভিযুক্তের শাস্তিও নিশ্চিত করা যায়।
পুলিশ সূত্র বলছে, সিসি ক্যামেরা বসানোর পাশাপাশি ফুটেজ সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে। সংরক্ষণ করা না হলে অনেক ফুটেজ মুছে ফেলার বা মুছে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। যেমন ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ মুছে ফেলায় ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আমবাগান ইউসেফ টেকনিক্যাল স্কুল ভোটকেন্দ্রের সামনে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আলাউদ্দিন নামের এক দিনমজুর নিহতের মামলার কিনারা এখনো হয়নি। শনাক্ত হয়নি অস্ত্রধারীরা। উদ্ধার হয়নি সংঘর্ষে ব্যবহৃত অস্ত্রও। মামলাটি থানা-পুলিশের পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে।
সিআইডি সূত্র বলছে, ওই সংঘর্ষে নিহত দিনমজুর আলাউদ্দিন কারও অনুসারী ছিলেন না। ভোটকেন্দ্রসংলগ্ন রেললাইনের লাগোয়া বস্তিতে থাকতেন তিনি। সকালে নাশতা খেয়ে কাজে যাওয়ার পথে নিহত হন।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশনস) আনোয়ার হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, অপরাধী শনাক্তে তথ্যপ্রযুক্তি এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কোনো এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকলে সেখানে এমনিতে অপরাধ কমে যায়। আবার কিছু ঘটলেও সহজে রহস্য উদ্ঘাটন করে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনাসহ দায়িত্বরতদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়।
তবে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ লবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সিসি ক্যামেরা বা তার ফুটেজ খুব সাহায্য করে। উন্নত বিশ্বেও তা করা হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, নির্দিষ্ট কোনো সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য যেন অসৎ উদ্দেশ্যে মানুষকে বিপদে না ফেলেন।
আপনার মতামত জানানঃ