মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশে ক্রসফায়ার কমলেও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছে৷ চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দুইটি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে৷ কিন্তু হেফাজাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ১১টি৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে গত বছর ২০২১ সালে ৫১ টি ক্রসফায়ার ও ২৯টি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে৷ ক্রসফায়ার বাদ দিয়ে ২০২০ সালে হেফাজতে মৃত্যু ২৪টি, ২০১৯ সালে হেফাজতে মৃত্যু ৩২টি, ২০১৮ সালে ৫৪টি এবং ২০১৭ সালে ৩৫টি৷
যে পুলিশ বাহিনীকে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করে, বিপদে তাদের সহায়তা চায়, সেই বাহিনীর কয়েকজন সদস্যের নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার কারণে পুলিশের অনেক প্রশংসামূলক কর্মকাণ্ড ধামাচাপা পড়ে যায়।
পুলিশ সদস্যদের এভাবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা পুলিশের পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে মনে করছেন অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা।
পুলিশ যখন আতঙ্কের নাম
সম্প্রতি দেখা গেছে, পুলিশ সদস্যরা থানায় সেবা নিতে আসা নারীদের ধর্ষণ করার মতো জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এ ছাড়া থানায় সেবা নিতে আসা অনেককে নির্যাতন, থানা হেফাজতে মৃত্যু, পুলিশি হেফাজত থেকে আসামি পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বাহিনীতে।
আবার নিজেরা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া, ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়া, ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানো, জমি দখলে সহায়তা করা, নিরপেক্ষ না থেকে ঘটনাস্থলে গিয়ে পক্ষ নিয়ে মারধরের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন পুলিশ সদস্যরা।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালীতে জেলা ট্রাফিক পুলিশের কোয়ার্টারে পুলিশ কনস্টেবলের তরুণীকে ধর্ষণ, গত ১৭ জুলাই রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালের সামনে একটি সোনার দোকানের কর্মচারীর কাছ থেকে ৩৮ ভরি ১৪ আনা স্বর্ণালংকার ছিনতাই করেন পুলিশের এক সহকারী উপপরিদর্শকের (এএসআই) নেতৃত্বে কয়েকজন।
গত ৮ জুলাই চট্টগ্রামে ইয়াবাসহ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) বিশেষ শাখার কনস্টেবল উপল চাকমা, নান্টু দাশ, কামরুল ইসলাম ও মো. গিয়াসউদ্দিন নামে চারজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ থানায় সেবা নিতে যাওয়া একজনকে পুলিশ সদস্যের শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও বেশ আলোচিত হয়।
এ ছাড়া ৩০ জুলাই দারুস সালাম এলাকায় দারুস সালাম থানার এসআই রেজাউল করিম এবং তার সোর্সসহ ইমরান নামে একজনকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করে। একই থানার এসআই বায়েজিদ মোল্লা গত ৩০ মে জমিজমা-সংক্রান্ত একটি বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে এক পক্ষের হয়ে মিম নামে এক ব্যক্তিকে বিনা কারণে থানায় নিয়ে আসে। মামলা দেওয়ার ভয়ভীতি দেখায়। যদিও ঘটনা দুটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে এলেও কোনও ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। উল্টো ভুক্তভোগী দুজনকে ডেকে এনে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখায় পুলিশ এমন অভিযোগ পাওয়া যায়। প্রথমে অভিযোগ করলেও পরবর্তীতে আর কোনও কথা বলতে রাজি হয়নি ভুক্তভোগীরা।
সম্প্রতি রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় আসামি ধরতে গিয়ে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ডিএমপি পল্লবী থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মাহবুবুল আলম ও তার সোর্সসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশ। নিজের দায়িত্বপূর্ণ থানা এলাকা পেরিয়ে অন্য থানায় এলাকায় গিয়ে এ ধরনের ঘটনার কারণে এরই মধ্যে এসআই মাহবুবুলকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানান পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পারভেজ ইসলাম।
পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশন্স বিভাগের এআইজি মো. কামরুজ্জামান বলেন, পুলিশ সদস্যদের বেশ কিছু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয় আমাদের নজরে এসেছে। আমরা এগুলো তদন্ত করছি। তদন্তে প্রমাণিত হলে যারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং হবে। বিভাগীয় নিয়ম-কানুন অনুযায়ী বিভাগীয় মামলা করা হয়, শাস্তি দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ সদর দফতর থেকে প্রতিনিয়ত নির্দেশনা দেওয়া হয়, একজন আসামিকে হেফাজতে নিয়ে গ্রেফতার করতে হবে। আসামির প্রতি আচরণ কেমন হবে, সবই একটি গাইডলাইনের আওতায় পড়ে। গাইডলাইনের বাইরে গিয়ে কেউ যদি অতি উৎসাহী হয়ে থাকে, তা একান্তই তার ব্যক্তিগত দায়। ব্যক্তিগত দায় ডিপার্টমেন্টের নয় বলেও জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশ সদস্যদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা পুলিশের পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অনেক সময় পুলিশ সদস্যদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তদবির চালায়, এতে একদিকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আর্থিক লাভবানের বিষয় থাকে, অন্যদিকে অপরাধ করেও পার পেয়ে যায় অসাধু পুলিশ সদস্যরা।
তবে দু-একজন পুলিশ সদস্যের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দায় পুরো বাহিনীর ওপর দেওয়া ঠিক নয়। অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হলে অনেকেই অপরাধ মনে কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকবে।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, পুলিশ সদস্যদের যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তদন্ত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। অপরাধ করে কেউ পার পাচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টি প্রায়ই আমরা দেখি। কোনও ভুক্তভোগী বিপদে পড়লেও পরে এসব কারণে মামলা করতে রাজি হয় না। এ ছাড়া ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর ঘটনা ধরা পড়লেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাঁচানোর চেষ্টা করে। এতে অপরাধীর সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আর্থিক বিষয় জড়িত থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি দেশের বা সমাজের মানুষের যে ভরসার জায়গাটি থাকার কথা, সেই জায়গার ব্যত্যয় ঘটেছে। থানায় আসামি নির্যাতন কিংবা আত্মহত্যার মতো ঘটনা দিন দিন বাড়ছে।
অনেক সময় ভয়ংকর আসামিরা পালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সেবা নিতে আসা লোকজনকে হয়রানি করা, নির্যাতন করা, কোনও ক্ষেত্রে ধর্ষণের মতো অভিযোগও আজ প্রমাণিত। পুলিশের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যাও যেমন বাড়ছে, অভিযোগের সংখ্যাও তেমনি বাড়ছে। এটা উদ্বেগের বিষয়।
তিনি আরও বলেন, সমাজে অপরাধপ্রবণতা কমানোর জন্য যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভূমিকা রাখবে, অপরাধীদের আইনের মুখোমুখি করবে, সাজার মুখোমুখি করে মানুষকে স্বাভাবিক ও স্বস্তিদায়ক জীবনযাত্রার সহায়ক পরিবেশ তৈরি করবে, সেই বাহিনী যখন নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তখন সমাজে অপরাধীদের অপরাধ করার উৎসাহ বা প্রবৃত্তি বেড়ে যায়। সে ধরনের একটি বাস্তবতা আমরা দেখছি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ