শত্রুর হাতে ধরা পড়ার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়- এই মানসিকতা বেশ পুরনো। ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা আছে, অনেক ঐতিহ্যবাহী রীতি আছে, যেখানে পরাজিত যোদ্ধারা শত্রুর হাতে বন্দিত্বের অপমান সহ্যের চেয়ে আত্মহত্যাকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছিলেন। এমনই এক আনুষ্ঠানিক আত্মহত্যা পদ্ধতি হল ‘সেপ্পুকু’ , যা অনেক ক্ষেত্রে ‘হারা-কিরি’ নামেও পরিচিত।
আত্মহত্যার এই রীতি আনুষ্ঠানিকভাবে সেপ্পুকু হিসেবেই পরিচিত জাপানের অধিবাসীদের কাছে, হারা-কিরি নামটি জাপানের বাইরের মানুষদের কাছেই বেশি প্রচলিত। তবে নাম দুটি ভিন্ন হলেও অর্থ একই। সেপ্পুকু বা হারা-কিরি অর্থ হল পেট কেটে ফেলা। হ্যাঁ, এই রীতিতে নিজেই নিজের পেট কেটে মৃত্যুবরণ করে আত্মহত্যাকারী।
স্বেচ্ছামৃত্যুর এই রীতির উৎস জাপান। জাপানের সামুরাই গোষ্ঠীর নাম শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। জাপানিজ যোদ্ধাদের বলা হতো ‘সামুরাই’। সামুরাই নামটি অভিজাত যোদ্ধাদের চিহ্নিত করার জন্য মূলত ব্যবহৃত হতো শুরুতে। তবে ১২ শতাব্দীতে জাপানের ক্ষমতায় উত্থিত হওয়া যোদ্ধা গোষ্ঠীর সকলের জন্যই এই নামটি ব্যবহৃত হয়। এই সামুরাই গোষ্ঠীতেই মর্যাদাসূচক জীবনদানের এই পদ্ধতির প্রচলন হয়।
কেন পেট কেটেই মারা যাওয়ার এই রীতি? প্রাচীন জাপানে ধারণা করা হতো, মানুষের আত্মার বাস হল পেটে। তাই পেট সম্পূর্ণ চিরে মৃত্যুটাকে ধরা হতো মারা যাওয়ার সবচেয়ে অকপট ও সাহসী উপায়। আর তাই এই বিশেষ অধিকার কেবল অভিজাত সামুরাই গোত্রেরই ছিল।
সাধারণ জনগণ স্বেচ্ছায় মৃত্যু বেছে নিলে ফাঁসিতে ঝুলে বা পানিতে ডুবে মারা যেতে পারত, সামুরাই গোত্রের মেয়েরা নিজের গলা কেটে মৃত্যুবরণ করতে পারত, সেই পদ্ধতিকে বলা হত ‘জিগাই (Jigai)’, কিন্তু সেপ্পুকু পালনের অধিকার ও মর্যাদা একমাত্র সামুরাই পুরুষ যোদ্ধাদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। একমাত্র সেপ্পুকু পালনের মাধ্যমেই একজন সামুরাই যোদ্ধা তার এবং পরিবারের সম্মান বাঁচাতে বা বজায় রাখতে পারতেন বলে মনে করা হতো। পরাজিত বা অসম্মানিত সামুরাই, যে আত্মহত্যার বদলে আত্মসমর্পণ বেছে নিত, সে সমাজের কাছে তিরস্কারের পাত্রে পরিণত হতো।
হারা-কিরির প্রথম নজির দেখা গিয়েছিল ১১৮০ সালে, ‘ইউজি (Uji)’র যুদ্ধের পর। প্রথম হারা-কিরি কার্যকর করেন মিনামোটো নো ইয়োরিমাশা। তিনি শত্রুর হাতে ধরা পড়ে নির্যাতনের স্বীকার হয়ে মূল্যবান তথ্য দেয়ার চেয়ে মৃত্যুকে বেছে নেন। এর আগপর্যন্ত সামুরাইদের মধ্যে এই ধারণা অত প্রচলিত ছিল না। কিন্তু এর পর থেকেই প্রাণত্যাগের এই নিয়মের প্রতি এক অসুস্থ জনপ্রিয়তা দেখা যায়। এমন পদ্ধতি আমাদের কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু মান-সম্মানকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া জাপানের ঐতিহ্যে এটি খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
মোটামুটি ১২ শতাব্দীর দিকে সেপ্পুকু বেশ বড় পরিসরে পরিচিতি পায়। কিন্তু ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত এই রীতি বেশ অগোছালোভাবেই পালিত হত। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম মেনে করা হতো না, মৃত্যুর প্রক্রিয়াও মানুষভেদে বিভিন্ন ছিল। সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি ছিল ‘ট্যানটো’ নামে ছোট একধরনের ধারালো ছুরি ব্যবহার করে লম্বালম্বিভাবে পেট চিরে ফেলা, আর সবচেয়ে কম প্রচলিত পদ্ধতি ছিল যেকোনো ছুরিকে এক জায়গায় বসিয়ে তার উপর পতিত হওয়া। এই অসামঞ্জস্যের আমূল পরিবর্তন আসে ‘এডো’ পিরিয়ডে (প্রায় ১৬০৩ থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত)। অর্থাৎ যেসময় তোকুগাওয়া শোগুনেট আর তাদের অধীনস্ত প্রায় ৩০০ ‘দাইমিয়ো’দের রাজত্ব ছিল জাপানিজ সমাজে।
এই সময়ে এসে সমাজের উপর স্তরের বাসিন্দারা বিভিন্ন জটিল ধাপ সংযোজনের মাধ্যমে সেপ্পুকুকে বেশ কঠোর একটি আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করে। প্রথম সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে সেপ্পুকু কোথায় অনুষ্ঠিত হবে, সে জায়গা নিয়ে। সাধারণত সেপ্পুকু পালন করার কথা যুদ্ধক্ষেত্রে, যখন যুদ্ধ জেতার সকল আশা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এডো পিরিয়ডে এই ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মহত্যার পরিবর্তে পরাজিত যোদ্ধাকে পরে বিশাল জনসমাগমে সেপ্পুকু পালন করতে হতো। এই ধরনের সেপ্পুকু ছিল বাধ্যতামূলক। অসম্মান থেকে পরাজিত সামুরাই যোদ্ধাকে বাঁচাতে মুখ্য শাস্তি হিসেবে এটি পালন করা হতো। বেশ আয়োজন করেই পালিত হতো এই রীতি।
প্রথমে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় সাদা কুশন বিছানো হতো। পরাজিত যোদ্ধাকে ধবধবে সাদা একটি কিমোনো (জাপানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক) পরে কুশনের উপর হাঁটু গেড়ে বসতে হতো। তাকে তার প্রিয় খাবার দেয়া হতো শেষ খাবার হিসেবে। পাশে ‘ট্যানটো’ অর্থাৎ পেট চেরার জন্য ছুরিটি নিয়ে শান্তভাবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে যোদ্ধা লিখত ‘মৃত্যু-কবিতা’, যা তার শেষ কথা ও সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হতো। এর পূর্বেই যোদ্ধা একজন ‘কাইশাকুনিন’ বা সাহায্যকারী বেছে নিতেন, যে তার পেছনে বামদিকে তলোয়ার নিয়ে প্রস্তুত থাকত। ট্যানটো দিয়ে পেট কাটার সাথে সাথেই কাইশাকুনিন মাথার পেছন দিকে তলোয়ারের আঘাতের মাধ্যমে যোদ্ধার মৃত্যু নিশ্চিত করত।
কাইশাকুনিনকে হতে হত বেশ দক্ষ তলোয়ারবাজ, কেননা তাকে মাথাটা এমনভাবে কাটতে হতো যেন সম্পূর্ণ মাথা ধড় থেকে আলাদা না হয়ে পড়ে। কিছুটা মাংস ধড়ের সাথে যুক্ত থেকে এমনভাবে মাথার অবস্থান নিশ্চিত করতে হতো যেন দেখে মনে হয় পরাজিত ঐ যোদ্ধা সামনের দিকে মাথা নত করে আছে। ১৮০০ সালের দিকে পুরো সেপ্পুকু পদ্ধতির কেন্দ্রীয় চরিত্রে চলে আসে কাইশাকুনিন। যদিও নিয়ম ছিল, প্রথমে যোদ্ধা পেট কাটবে এবং এর নির্দিষ্ট সময় পর কাইশাকুনিন তার মাথার পেছনে আঘাত করবে, কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যেত, পেটে আঘাতের সাথে সাথেই মাথায় আঘাত হয়ে গেছে। যত সময় যেতে লাগল, দেখা গেল যে যোদ্ধা তার পেটে ছুরি বসানোর আগেই কাইশাকুনিন মাথায় আঘাত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিচ্ছে।
বাধ্যতামূলক সেপ্পুকুর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন বলা যায় ৪৭ রনিনের ঘটনাকে। রনিন বলা হত প্রভুহীন সামুরাই যোদ্ধাদের, যারা প্রায়ই থাকত ভবঘুরে ও সক্রিয়ভাবে বিদ্রোহী। ৪৭ রনিন প্রভুহীন হয়ে পড়ে, যখন তাদের প্রভু ‘আসানো নাগানোরি’কে বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে হত্যা করা হয়। আসানোকে হত্যার জন্য তারা শোগুন (জাপানের তৎকালীন সামরিক একনায়ক) তোকুগাওয়া সুনায়োশির অধীনস্ত দাইমিয়ো ‘কিরা ইয়োশিনাকা’কে দায়ী ধরে তাকে হত্যা করে। এই ঘটনার পর শোগুন সেই ৪৭ রনিনকে সেপ্পুকু পালনের নির্দেশ দেয়।
আরেক ধরনের সেপ্পুকু ছিল স্বেচ্ছাকৃত। এটি ছিল মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত যোদ্ধাদের শত্রুর হাতে পড়ার চেয়ে মৃত্যু বেছে নেয়া। ধীরে ধীরে কোনো সামুরাই তার প্রভুর প্রতি বিশ্বস্ততার নজির হিসেবে কিংবা কোনো সরকার বা রাজনৈতিক নেতার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ হিসেবে বা নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে স্বেচ্ছায় সেপ্পুকু পালন শুরু করে। আধুনিক জাপানেও স্বেচ্ছা সেপ্পুকুর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য নজির আছে, যার একটি হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর বেশ কিছু সামরিক সেনার সেপ্পুকু পালনের মাধ্যমে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া। প্রায় ১৫ সেন্টিমিটারের একটি চাকু দিয়ে পেটের বাম থেকে ডান দিকে কাটার মাধ্যমে তারা আত্মহত্যা করেন।
আরেকটি বিখ্যাত সেপ্পুকুর ঘটনা ঘটে ১৯৭০ সালে, যখন জাপানের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক মিশিমা ইউকিয়ো নিজের পেট কেটে জনসম্মুখে মৃত্যুবরণ করেন। জাপানের ঐতিহ্যের মূল্য হারানোর ব্যাপারে তার চিন্তাভাবনাকে সমর্থন দিতেই তিনি এই পথ বেছে নেন।
বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্র, লেখা ও নাটকে সেপ্পুকুর বিভিন্ন রূপ উঠে এসেছে। সেগুলো বিশ্লেষণ করলে স্বেচ্ছা সেপ্পুকুকে আরো কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। সাধারণত চলচ্চিত্রে এই সেপ্পুকুর নতুন একটি ধরন প্রকাশ পায়, যাকে বলা হত ‘কানশি’, যেখানে কোনো রাজনৈতিক নেতা বা ভূস্বামীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে সেপ্পুকু পালন করা হতো। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ সেপ্পুকুর চেয়ে পার্থক্য থাকত যে, এক্ষেত্রে সামুরাই যোদ্ধারা পেটে বেশ গভীর ক্ষত সৃষ্টি করত এবং যত দ্রুত সম্ভব তা ব্যান্ডেজ করে ফেলত। পরবর্তীতে জনতার সামনে সে তার বক্তব্য রাখত এবং সেই ক্ষত উন্মোচন করত প্রতিবাদের প্রতি তার একাত্মতা হিসেবে।
এই ধরনটি ‘ফুনশি’ বা ধিক্কারের মৃত্যু থেকে একদম আলাদা। ফুনশিকে ধরা হত সেপ্পুকুর বিশেষভাবে চিত্রায়িত করা এক মাধ্যম। কোনো অসন্তোষ বা প্রতিবাদের পক্ষে শক্তিশালী পক্ষ রাখতে গিয়ে সামুরাই যোদ্ধারা এই সেপ্পুকু পালন করত। জাপানের নাট্যশালায় আবার সেপ্পুকুর এক কল্পিত সংস্করণ ছিল, যাকে ‘কাজিবারা’ বলা হত। আবার কিছু সামুরাই ‘জুমোঞ্জি গিরি’ নামে সেপ্পুকুর এক ধরন বেছে নিত। এই পদ্ধতিতে কোনো কাইশাকুনিন মঞ্জুর করা হতো না। পেট আনুভূমিকভাবে কেটে ট্যানটো দিয়ে আবার বুক থেকে নিচের দিকে লম্বা ক্ষত করা হয় এ পদ্ধতিতে। এটি বিশেষভাবে সেপ্পুকুর বেদনাদায়ক পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত, কারণ এতে ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণের মাধ্যমে মৃত্যু ঘটে।
সম্রাট মেইজি (Meiji) দ্বারা মেইজি সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের পর ১৮৭৩ সালের দিকে বিচারিক শাস্তি হিসেবে সেপ্পুকুর প্রচলন একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রশাসনিকভাবে প্রচলিত না থাকলেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এর অনুশীলন জাপানে চলতেই থাকে।
যদিও সামুরাই গোত্রে সেপ্পুকু বা হারা-কিরি বেশ সম্মানজনক মৃত্যু হিসেবে গণ্য করা হয়, কিন্তু বেশ অনেকবারই প্রশ্ন ওঠে যে আসলেই এটি সম্মানজনক নাকি নিছকই ঠুনকো গর্ব বজায় রাখার চেষ্টা? পরিচালক কোবায়াশি পরিচালিত ‘হারা-কিরি’ নামের চলচ্চিত্রে হারা-কিরি বা সেপ্পুকুর অন্য আরেকটি রূপ ফুটে ওঠে। প্রভুহীন সামুরাই যোদ্ধা অর্থাৎ রনিনদের অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশা পরিচালক চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলেন। চলচ্চিত্রটিতে দেখা যায়, মোটোমি নামক এক তরুণ রনিন লি গোত্রের প্রাসাদের সামনে সেপ্পুকু পালনের অনুমতি চায়।
তখনকার সময়ে রনিনদের অবস্থা বেশ করুণ ছিল, কাজ নেই, তাই নেই উপার্জনও। মোটোমি শুনেছিল, আগে একজন রনিন এভাবে সেপ্পুকু পালন করতে চাওয়ায় তাকে বেশকিছু পয়সাকড়ি দিয়ে বিদায় করে দেয়া হয়। অসুস্থ স্ত্রী ও বাচ্চার চিকিৎসার জন্য সে একইভাবে কিছু অর্থ পাওয়ার আশায় এই কাজটি করে। কিন্তু এরকম রনিনদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে ও তা কমানোর জন্য একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে- এমন চিন্তা থেকে গোত্রের তিন বয়োজ্যেষ্ঠ সামুরাই মোটমিকে শিক্ষা দেয়ার চিন্তা করেন। তাকে জোর করা হয় সেপ্পুকু পালনে। তার বাঁশের তলোয়ার দিয়েই তাকে সেপ্পুকু পালনে বাধ্য করা হয়। আসলেই সেপ্পুকু বা হারা-কিরির মর্যাদা রক্ষা ব্যাপারটি কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা-ই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে চলচ্চিত্রটিতে। জোর করে বা শাস্তি হিসেবে এই পীড়াদায়ক পদ্ধতিতে কাউকে মরতে বাধ্য করা কতটা যুক্তিসঙ্গত ছিল সে প্রশ্ন রয়েই যায়।
আপনার মতামত জানানঃ