এক সময় সেনাবাহিনীর ‘প্রিয় পুত্র’ থেকে এখন সাইডলাইনে ছিটকে গেছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তার বিরুদ্ধে দীর্ঘ কারাদণ্ডের রায় দিয়েছে আদালত। আগামী ৮ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না তিনি। তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআইও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, ইমরান খানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার কি এখানেই শেষ? নাকি তিনি আবারও ফিরে আসতে পারবেন পাকিস্তানের ক্ষমতায়!
১৯৫২ সালে লাহোরে জন্ম হয় ইমরান খানের। প্রথমে ক্রিকেট আর এরপর রাজনীতি দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নেন তিনি। ১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান তার একমাত্র ওডিআই বিশ্বকাপ জয় লাভ করে। ক্রিকেট থেকে অবসরের পর তিনি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন পিটিআই। যদিও ২০১১ সাল পর্যন্ত তেমন বড় কোনো সফলতা পায়নি দলটি।
তবে দুর্নীতি ও বেকারত্ব ইস্যুকে সামনে এনে গত এক দশকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসেন ইমরান খান। ২০১৩ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আনেন তিনি। রাজধানী ইসলামাবাদে কয়েক মাস ধরে প্রতিবাদ সমাবেশ করে তার দল। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ইমরান। তারপরেও নির্বাচনে তার জয় নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়। অনেকেই অভিযোগ করেন যে, সেনাবাহিনীর সহায়তায় তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
নির্বাচিত হয়েই তিনি পাকিস্তানকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোভিড-১৯, মূল্যস্ফীতি এবং রিজার্ভ ঘাটতির মতো ইস্যুতে বার বার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন তিনি। সেনাবাহিনীর সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে তার। ২০২১ সালে গোয়েন্দা প্রধান নিয়োগ ইস্যু নিয়ে সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে ইমরান খানের তিক্ততা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
এদিকে তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে বিরোধী দলগুলো গঠন করে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট বা পিডিএম। তারা ইমরান খানের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা বিল উত্থাপন করে। সেসময় নানা নাটকীয়তার পর ২০২২ সালের ১০ই এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান ইমরান খান। তার এই পরিনতির জন্য তিনি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে দায়ী করেন। তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইশারাতেই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। প্রকাশ্য বক্তৃতায়ও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
ক্ষমতা হারানোর পর ইমরান খানকে চুপ করাতে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়। এরমধ্যে তোশাখানা ও সাইফার মামলা সবথেকে বেশি আলোচিত হয়েছে। এছাড়া তাকে হত্যায় গুলিও চালানো হয়। তিনি গুলিবিদ্ধ হলেও প্রাণে বেঁচে যান।
২০২৩ সালের ৯ই মে ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হলে পুরো পাকিস্তান ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেসময় পাকিস্তানজুড়ে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যে তীব্র জনরোষ দেখা যায়, তা ছিল নজিরবিহীন।
সেনাবাহিনীর নানা অবকাঠামোতে হামলা চালায় জনতা। এই ঘটনাকে ‘কালো অধ্যায়’ বলে দাবি করে পাক সামরিক বাহিনী। ওই বিক্ষোভের পরই ইমরান খান ও তার দলের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করে পিডিএম সরকার। গ্রেপ্তার করা হয় হাজার হাজার পিটিআই নেতাকর্মীকে। তাদের অনেকেই এখনও জেলে রয়েছেন। ইমরান খানকে গ্রেপ্তার না করলেও তার দলের নেতাদের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করা হয়। এতে দলের অনেক বড় নেতাই নির্যাতন ও কারাদণ্ড এড়াতে পদত্যাগে বাধ্য হন। সেখান থেকেই মূলত শুরু হয় ইমরান খানের পতন।
এই ধারাবাহিকতায় গত ৫ই আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। তোশাখানা মামলায় তার তিন বছরের কারাদণ্ড হয়। তাকে পাঁচ বছরের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। এমনকি তার দলীয় প্রধানের পদও কেড়ে নেয়া হয়। এরপর গত ৩১শে জানুয়ারি তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। একই সাজা পেয়েছেন তার স্ত্রী বুশরা বিবিও। এর মাত্র একদিন আগে সাইফার মামলায় ইমরান ও তার দলের আরেক শীর্ষ নেতা পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয় পাকিস্তানি আদালত।
আগামী ৮ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না ইমরান খান। বুধবারের রায়ে সরকারি পদে ইমরান খানের নিষেধাজ্ঞা বেড়ে ১০ বছর হয়েছে। এরফলে ২০৩৪ সালের আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে ফের বসতে পারবেন না তিনি। ইমরান খান মাসের পর মাস ধরে বন্দি থাকায় তার দল পিটিআইর মধ্যেও বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। অনেক প্রধান নেতা জেলে আছেন কিংবা পলাতক অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। আবার মামলার ভয়ে অনেকেই তার সঙ্গ ত্যাগ করেছেন।
তবে আগামী সপ্তাহের নির্বাচনে পিটিআই’র সমর্থনপ্রাপ্ত অনেক প্রার্থী ভোটে লড়বেন। কিন্তু ইমরান খানের গ্রেপ্তারের পর পিটিআইর হাল ধরার মতো বড় মাপের আর কোনো নেতা দেখা যায়নি। বর্তমানে সাময়িকভাবে পিটিআই’র নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বল্পপরিচিত আইনজীবী গহর আলী খান। তিনি ইমরানের আইনি পরামর্শকও। গত ১৪ জানুয়ারি পাকিস্তানি আদালত জানায়, পিটিআই তার ঐতিহ্যবাহী ব্যাট প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে না। ফলে এই নির্বাচনে দলটির প্রার্থীরা স্বতন্ত্র হিসেবে লড়বেন। তাই ইমরান খানের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা যদি জিতেও যান, তবুও স্বতন্ত্র হিসেবে তারা চাইলেই অন্য দলে যোগ দিতে পারবেন।
নির্বাচনের পর সরকার গঠনের জন্য পার্লামেন্টে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী যেকোনো দলের জন্য বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ হবে। এখন ইমরানের ভাগ্য অনেকটা নির্ধারিত হবে তখনই। স্বতন্ত্র প্রার্থিরা যদি শেষ পর্যন্ত ইমরানের পাশে থাকেন তাহলে হয়ত শিগগিরই রাজনীতির মাঠে ফিরতে পারবেন তিনি। তবে আপাত দৃষ্টিতে সেই সম্ভাবনা বেশ কম।
পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের সেক্রেটারি-জেনারেল হারিস খালিক বলেন, পিটিআইর বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর এত সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, তারা ইমরান খানের জনপ্রিয়তা হ্রাস করতে সক্ষম হয়নি। ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে ইমরান খান ভূমিধস বিজয় নিয়ে আবারও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেন। কিন্তু তাকে ছাড়াই নির্বাচন হলে তার কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না। নির্বাচনের আগে ইমরান খানকে কারাবন্দি রাখতে তার বিরুদ্ধে এসব রায় পাকিস্তানের বিচার বিভাগকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
পিটিআই মুখপাত্র রওফ হাসান বলেন, আমরা পিটিআই প্রার্থীদের জয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। আমরা ভোটারের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে চাই। জনগণের অবাধ রাজনৈতিক অংশগ্রহণের জন্য লড়াই করে যাবে পিটিআই।
ইমরান খান কারাগারে থাকলেও অনেক জনমত জরিপ বলছে, পিটিআই তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। ডয়চে ভেলের এক রিপোর্টে সম্প্রতি বলা হয় যে, ইমরান খান জেলে থাকলেও পাকিস্তানিরা তার পক্ষেই ভোট দেবে। সাধারণ মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, সামরিক বাহিনীই ইমরান খানকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতেই এসব চাল সাজিয়েছে। এখন আগামী ৮ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জনগণের কণ্ঠস্বর কতটা প্রতিফলিত হবে তাই দেখার বিষয়।
আপনার মতামত জানানঃ