ভূরাজনীতির উত্তেজনা আগে থেকেই বিশ্ব অর্থনীতিতে জেঁকে বসে আছে। সর্বশেষ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাগরের গুরুত্বপূর্ণ এক জলপথে জাহাজের ওপর ইয়েমেনের হুতি যোদ্ধাদের হামলা। এ হামলা আবার ঘটছে গাজায় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের জেরে। ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির জগতে টালমাটাল যে অবস্থা ইতিমধ্যে রয়েছে, তাতে অস্থিতিশীলতার আরেকটি ডোজ যুক্ত হয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি সংকটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এর আগে ছিল কোভিড-১৯ ও ইউক্রেনে যুদ্ধ। বিশ্বের অর্থনীতিতে এসব ঘটনা বড় অঘটন হিসেবে এসেছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতি পথ হারিয়েছে, অর্থনীতিতে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে।
তবে এগুলোই যেন শেষ নয়। আগামীতে আসছে একের পর এক নির্বাচন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, নানা প্রান্তে। যে অস্থিরতা এসব নির্বাচনের কারণে তৈরি হবে, তার ফলাফল হবে গভীর ও সুদূরপ্রসারী।
কমবেশি ৫০টি দেশে ২০০ কোটির বেশি মানুষ ২০২৪ সালে ভোট দেবেন। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও ২৭ সদস্যের ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নতুন বছরে ভোট হবে।
২০২৪ সালের নির্বাচন অলিম্পিয়াডে যেসব দেশ যোগ দিচ্ছে, সব মিলিয়ে তাদের অর্থনীতির আকার বৈশ্বিক অর্থনীতির ৬০ শতাংশ। অনেক দেশেই সরকারের বিরুদ্ধ অবিশ্বাস বাড়ছে, ভোটাররা তিক্তপূর্ণভাবে বিভক্ত। আবার অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ আছে অনেক দেশে।
যেসব দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু নয়, সেসব দেশেও অর্থনীতির সর্বশেষ হালচাল নিয়ে নেতারা স্পর্শকাতর। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আদেশ দিয়েছেন রপ্তানি আয় দ্রুত রুবলে রূপান্তরিত করতে হবে। সম্ভবত এটা করা হয়েছে দেশটির মুদ্রা রুবলকে শক্তিশালী করতে। আগামী মার্চে রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, তাই পুতিন দ্রব্যমূল্য কমাতে চান।
বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে যাঁরা জিতবেন, তাঁরা ঠিক করবেন ভর্তুকি, কর-সুবিধা, প্রযুক্তি হস্তান্তর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন, নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা, বাণিজ্য বাধা, বিনিয়োগ, ঋণ মওকুফ ও জ্বালানি রূপান্তর—এসব বিষয়ে ওই দেশের নীতি কী হবে। এসব নীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি দেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি এসব নীতির ওপর নির্ভর করে।
জনতুষ্টির লক্ষ্য নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তারা যদি নির্বাচনে জিতে যায়, তাহলে সেসব সরকার বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অভিবাসনে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপের পথে হাঁটতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের জননীতির অধ্যাপক ডায়ান কোয়েল বলেন, এসব নীতি বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ‘এমন এক দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা আমাদের পরিচিত অর্থনীতি থেকে পুরোপুরি অন্য রকম’।
নিশ্চল আয়, জীবনযাত্রার মানের অবনতি ও ক্রমশ প্রকট হওয়া বৈষম্যের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশ্বায়নের বিষয়ে সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলেছে। ডায়ান কোয়েল যেমনটা বলেছেন, ‘বিশ্বে যখন বাণিজ্য কমে যায়, তখন মানুষের আয়ও কমে।’
আর সে কারণেই একটি ‘দুষ্টচক্র’ গড়ে ওঠার আশঙ্কা বাড়ে। কারণ, ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীদের ক্ষমতায় আসার ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি দুর্বল করতে পারে। ডায়ান কোয়েল মনে করেন, এতে অর্থনীতির সম্ভাবনায়ও ক্ষত তৈরি হয়।
অনেক অর্থনীতিবিদ বর্তমান অবস্থার সঙ্গে ১৯৭০ দশকের পরিস্থিতির তুলনা করেন। তবে ডায়ান কোয়েল অবশ্য মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে বরং ১৯৩০ দশকের মিল অনেক বেশি। সে সময়ের অস্থির রাজনীতি ও আর্থিক অসাম্য জনতুষ্টিবাদ উসকে দিয়েছিল। ফলে বাণিজ্যিক লেনদেন কমে, আর বাড়ে কট্টর রাজনৈতিক ভাবনা।
নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষের নির্বাচন হবে ভারতে। এটি এ মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি, চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশটি বিশ্বের উৎপাদন কেন্দ্র হতে চায়। জানুয়ারিতে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে আরেক দফা উত্তেজনা তৈরি হতে পারে।
মেক্সিকোতে জ্বালানি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নীতি কী হবে, তা ঠিক করবেন ভোটাররা। আর ইন্দোনেশিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট নিকেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ধাতুর বিষয়ে নীতি পরিবর্তন করতে পারেন।
অন্যদিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচন এরই মধ্যে নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখা শুরু করেছে। গত সপ্তাহে ইউরোপের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম এবং মার্কিন হুইস্কি ও মোটরসাইকেলের শুল্ক নিয়ে আলোচনা আগামী নির্বাচনের পর করার বিষয়ে ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলস একমত হয়েছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হবেন। তিনি প্রবলভাবে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে আসা সব পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এটি হবে এমন একটি পদক্ষেপ, যা পৃথিবীর অন্য দেশকেও একই রকম পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথাবার্তা একনায়কদেরই স্মরণ করিয়ে দেয়। ইতিমধ্যেই তিনি যথেষ্ট জোরালো ইঙ্গিত দিয়েছেন, আবার নির্বাচিত হলে তিনি ইউরোপের সঙ্গে আমেরিকার দীর্ঘদিনের অংশীদারত্ব ভেঙে দেবেন, ইউক্রেনের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবেন এবং চীনের সঙ্গে আরও সংঘাতমূলক অবস্থান গ্রহণ করবেন।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইওয়াই-পার্থেনন সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘এ নির্বাচনের ফলাফল অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক নীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে পারে। এসব নীতির মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও বৈশ্বিক জোটের বিষয়াবলি।’
২০২৪ সালের অর্থনৈতিক পূর্বাভাস এখন পর্যন্ত মিশ্র। বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চলে প্রবৃদ্ধি শ্লথ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বেশ অনেকগুলো উন্নয়নশীল দেশ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হবে, এমন আশঙ্কা রয়েছে। তবে ইতিবাচক দিক হলো, মূল্যস্ফীতির দ্রুত পতন কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে সুদের হার কমাতে কিংবা এ হার আর না বাড়াতে উৎসাহিত করছে। ঋণ করার খরচ কমে এলে বিনিয়োগ বাড়ে এবং মানুষ বাড়ি কেনেন।
তবে বিশ্বে যেহেতু নতুন নতুন জোট হচ্ছে, তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ছে, তাই অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার উদ্বেগগুলো আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি বিবেচনা করা হবে।
রাশিয়ার তেল, গ্যাস ও কয়লা আরও বেশি পরিমাণে কিনছে চীন, ভারত ও তুরস্ক। ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর ইউরোপ রুশ জ্বালানি কেনা ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছিল। এ সময়েই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে ওয়াশিংটন বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ি, সেমিকন্ডাক্টর ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত অনেক খাতে বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা দিতে শুরু করে।
লোহিত সাগরে জাহাজের ওপর ইরান-সমর্থিত হুতি গোষ্ঠীর ড্রোন ও মিসাইল হামলা বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তির চিত্রটি আরও পরিষ্কার করেছে।
ইওয়াই-পার্থেননের ভূরাজনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক ও প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা প্রতিবেদনের লেখক কোর্টনি রিকার্ট ম্যাকক্যাফ্রি বলেন, সাম্প্রতিক সময় ইয়েমেন, হামাস, আজারবাইজান ও ভেনেজুয়েলার মতো শক্তির উত্থান ঘটেছে, যারা আর প্রচলিত ব্যবস্থা মেনে নিতে আগ্রহী নয়।
কোর্টনি রিকার্ট ম্যাকক্যাফ্রি বলেন, ‘যদিও এসব সংঘাত আকারে ছোট, তারপরও এগুলো অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে বিশ্বের সরবরাহব্যবস্থা ওলটপালট করতে পারে। ভূরাজনৈতিক শক্তিগুলো আগের চেয়ে বেশি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে।’ তাঁর মতে, ফলে উত্তেজনা বেড়ে চলেছে।
অনিশ্চয়তা অর্থনীতিকে নির্জীব করে তোলে। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠাগুলো ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়ে আগায়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ভূরাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক সম্পর্কে অব্যাহত অস্থিরতা সরকারি ও বেসরকারি খাতের জন্য মূল উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই চলমান সামরিক সংঘাত, চরম আবহাওয়া ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দেশে নির্বাচন ২০২৪ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে না।
আপনার মতামত জানানঃ