কল্লোল দাশ বনি : আমাজনের জেফ বেজোস, মাইক্রোসফটের বিল গেটসকে পেছনে ফেলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনী ব্যক্তির খেতাব জিতে নিয়েছেন ইলন মাস্ক। ইলন মাস্ককে কিভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় কে জানে। টেসলার ইলন মাস্ক? স্পেইস এক্সের ইলন মাস্ক? স্টার লিঙ্কের ইলন মাস্ক? হাইপার লুপের ইলন মাস্ক? নাকি সোলার সিটির ইলন মাস্ক? এই ভদ্রলোক তার এক জীবনে যে সমস্ত অভূতপূর্ব কর্মকান্ড ঘটিয়ে চলেছেন তা যেকোন মানুষ স্বাভাবিকভাবে চিন্তাও করতে পারবে না। তাকে জানলে মনে হয় কোন এক সায়েন্স ফিকশন উপন্যাসের চরিত্র, যে কিনা ভবিষ্যৎ থেকে টাইম ট্রাভেল করে আমাদের এই অভিশপ্ত পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাকে অনেকে আগামী পৃথিবীর ঈশ্বর বলেও মনে করেন। নিচে তার কিছু কর্মযজ্ঞের কথা তুলে ধরা হল।
পেপ্যাল : অনলাইনে কেনাকাটা করেছেন আর পেপালের নাম শুনেননি এটা তো হতে পারে না। সারা বিশ্বব্যাপী অনলাইন মানি ট্রান্সফারের সবচেয়ে জনপ্রিয় এপ পেপালের দুইজন প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে একজন কিন্তু এই ইলন মাস্ক। পরে অবশ্য তিনি এটিকে প্রায় সাড়ে ষোল কোটি ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন।
টেসলা : ইলেক্ট্রনিক গাড়ি নিয়ে গত শতকের শেষের দিকে খুব জল্পনা কল্পনা চলছিলো। পরিবেশ বান্ধব বলে সচেতন মানুষরা একে নিয়ে অনেক আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু, ইলেক্ট্রনিক গাড়ির সমস্যা হল এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং তেলের গাড়ির মত জোরে চলতে পারে না। আবার একবার চার্জ দিয়ে খুব বেশিদূর চলতেও পারে না। ফলে সাধারণ মানুষের ইলেক্ট্রনিক গাড়ি নিয়ে আশার ফানুস উড়ে যেতে সময় লাগলো না।
কিন্তু এই চিত্র বদলে গেলো যখন মাঠে নামলেন ইলন মাস্ক। ২০০৩ সালে আরও দুইজন অংশিদারকে সাথে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তার গাড়ির কোম্পানি টেসলা। এই কোম্পানির রোডস্টার নামের একটি কার তৈরি করেন, যা একবার চার্জে দিলে ২৪৫ মাইল বা ৩৯৪ কিলোমিটার যেতে সক্ষম। রোডস্টার এমন এক স্পোর্টস কার যা শূন্য থেকে ৬০ মাইল গতি অর্জন করতে কেবল ৪ সেকেন্ড সময় নেয়, যা বাজারে প্রতিষ্ঠিত অনেক নামীদামী ব্র্যান্ডের তেল চালিত স্পোর্টস কারের চেয়ে বেশি।
স্পেইস এক্স : মাস্ক সবসময়ই বিশ্বাস করেন মানুষকে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই পৃথিবীর বাইরেও নতুন কোনো স্থানে বসতি গড়ে তুলতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় তার নতুন প্রজেক্ট। ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে জন্ম নেয় স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস। সংক্ষেপে যাকে এখন ‘স্পেস এক্স’ নামেই সবাই চেনে।
পৃথিবীর সেরা মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র “নাসা” যা করতে পারে নি তা করে দেখিয়েছে স্পেইস এক্স। এই প্রতিষ্ঠানই প্রথম পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট নির্মাণ করেছেন যা পৃথিবী থেকে একাধিকবার মহাকাশে পাঠানো ও ফেরত আনা যায়। তার এই উদ্যোগের কারণে মহাকাশে রকেট পাঠানোর খরচ ৯০% এরও বেশি সাশ্রয় হয়েছে। ২০১০ সালে তাদের নির্মিত রকেট ড্রাগনের উড্ডয়নের মাধ্যমে স্পেস এক্স অর্জন করে প্রথম ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি হিসেবে মহাকাশে স্পেস ক্রাফট মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানের সম্মান। দুই বছর পরেই প্রথম প্রাইভেট কোম্পানি হিসেবে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে নামা প্রতিষ্ঠানের সম্মান অর্জন করে কোম্পানিটি। এছাড়াও সৌখিন ও পয়সাওলা ব্যক্তিদের মহাকাশে ট্যুরে পাঠানোর জন্যও তার কোম্পানির রয়েছে আকর্ষণীয় মহাকাশ ট্রাভেল প্রজেক্ট। এখন মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপন নিয়ে তারা কাজকর্ম করছেন।
স্টার লিংক : ইলন মাস্কের আরেকটি উদ্ভট প্রজেক্ট হল এই স্টারলিংক। মহাকাশে অনেকগুলো রকেট পাঠিয়ে সারা পৃথিবীকে ইন্টারনেট পরিষেবার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য। বিষয়টা শুনতে যত সরল মনে হচ্ছে বাস্তবে তা মোটেও নয়। এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য মহাকাশে ১২০০০ স্যাটেলাইট পাঠানো হবে। আমরা যেখানে এক বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পাঠানোর গর্বে হৈ হুল্লোড় করতে করতে থামতে পারছি না, সেখানে ইলন মাস্ক একাই তার কোম্পানির সাহায্যে মহাকাশে বারো হাজার স্যাটেলাইট পাঠাবেন। এরপরে তার ঐসব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আফ্রিকার গহীন জঙ্গল থেকে এন্টার্কোটিকার দুর্গম হিমবাহ কিংবা প্রশান্ত মহাসাগরের নির্জনতম স্থানেও আপনি পেয়ে যাবেন তার কোম্পানির ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক। দারুন না?
হাইপার লুপ : সবাই যখন ভবিষ্যতের যাতায়াত ব্যবস্থার কথা ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাতেন, ড্রোন কিংবা উড়ন্ত গাড়ি নিয়ে হাইফাই প্রযুক্তির কথা ভাবতেন তখন এই ইলন মাস্ক নজর দিলেন পাতালে, অর্থাৎ মাটির নিচে। তার প্রতিষ্ঠিত আরেকটি কোম্পানি “দ্যা বোরিং কোম্পানি” মাটির নিচে টানেল খুঁড়ে এমন একটা যোগাযোগ ব্যবস্থা বানাবে যেখানে মানুষ ঘন্টায় ৯০০ থেকে ১৫০০ কিমি বেগে যাতায়াত করতে পারবে। অর্থাৎ, একটা জেট বিমানের চেয়েও বেশি গতি। ভাবা যায়? ইতিমধ্যে দুবাইর শাসকের আনুকূল্যে এই প্রজেক্টের সফল বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়েছে।
সোলার সিটি : ইলন মাস্ক প্ল্যান করেছেন তিনি এমন এক ধরণের সোলার প্যানেল বানাবেন যা একই সাথে ঘরের ছাদ হিসেবে ব্যবহৃত হবে, পাশাপাশি সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার জোগান ঘটাবে এবং তার উৎপাদিত প্যানেলের মূল্য হবে সবচেয়ে কম। সেই লক্ষ্যে তিনি নতুন একটি কোম্পানি বানালেন যার নাম হল সোলার সিটি।
নিউরালিংক : এমন যদি হয়, ছুটির দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি মনে মনে ভাবলেন আহা এখন একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনলে মন্দ হত না, আর অমনি ঘরের স্পীকারে বাজতে শুরু করল কলিম শরাফির দরাজ কন্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত। কিংবা আপনি মনে মনে ভাবলেন শেয়ার মার্কেটে আপনার কাছে যে যে কোম্পানির শেয়ার আছে সেইসব শেয়ারের আজকের রেট কত, আর অমনি কম্পিউটারের স্ক্রিনে আপনার কেনা শেয়ারের সেইদিনকার রেইট ভেসে উঠতে শুরু হল। কি মনে হচ্ছে? রুপকথার গল্প? আপনার মনের কথাকে বুঝে ফেলার এই আইডিয়াকে একেবারে বাকোয়াস বলে ভাবছেন? তাহলে জেনে রাখুন আপনার আমার জন্য এসব ভাবনা বাকোয়াস হলেও ইলন মাস্কের কাছে এটা একটা বাস্তবতা। তিনি মানুষের ব্রেইনকে কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত করার জন্য একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন, যার নাম হল নিউরালিংক। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে সেইসব কাজই হবে যা আগে উল্লেখ করলাম এবং আরও অনেক অবিশ্বাস্য কাজ সম্ভব হবে এই প্রজেক্টের হাত ধরে।
এক বসায় ইলন মাস্ক সম্পর্কে সব কথা বলে শেষ করে যাবে না। এই লোক এক অবিশ্বাস্য রুপকথার চরিত্র যে বাস করে বাস্তবের পৃথিবীতে কিন্ত কাজ করে যাদুবাস্তবতায়। তার কাজে, তার চিন্তায় এবং তাকে আমার কাছে এক যাদুকর বলেই ভ্রম হয়। তবে এই লোককে আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি তার মানব সমাজকে নিয়ে চিন্তা ভাবনার কারণে। ইলন মাস্ক শুধু ব্যবসার কারণে ব্যবসা করে না, তার প্রতিটি ড্রিম প্রজেক্টে জড়িয়ে আছে গোটা মানব সমাজের মঙ্গল, পুরো পৃথিবীর কল্যানের চিন্তা। ইলন মাস্ক বেঁচে থাকুক, আরও কিছু যাদুর খেলা আমাদের দেখাক। ভবিষ্যতের সুপার হিরোকে বর্তমান সময়ে দেখা কম সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়।
এসডব্লিউ/কেডিবি/নসদ/০১২৫
আপনার মতামত জানানঃ