আজ মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হওয়ার আগে যদি নাটকীয় কিছু না ঘটে, তাহলে শেষ পর্যন্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে প্রধানত আওয়ামী লীগ প্রার্থী বনাম আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত প্রার্থীর লড়াই।
চাপ ও প্রলোভনের বিভিন্ন কৌশল দেখিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা যতই বাড়ানো হোক, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো দল নয়, দলেরই নকল বা ডামি প্রার্থী অথবা বিদ্রোহী, যাঁদের পরিচয় দাঁড়াবে স্বতন্ত্র প্রার্থী।
তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যাধিক্য দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও আওয়ামী লীগকে ভাবাচ্ছে। প্রতিটি আসনে গড়ে তাদের ১৩ জন মনোনয়ন চেয়েছিলেন বলে জানা যায়। তাঁদের মধ্যে আবার ৭০ জনের পুনর্নির্বাচনের আশা ছিল।
ফলে দলীয় প্রার্থীদের অনেকেরই শেষ পর্যন্ত বিপদ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। দলীয় মনোনয়ন পেলেই যে জেতার মতো প্রয়োজনীয় শক্তি-সামর্থ্য সবার থাকে না, তার প্রমাণ তো দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ, যিনি এখন বলতে শুরু করেছেন, তিনি ‘ফকিন্নির ছেলে’ নন। যদিও সংবিধান ‘ফকিন্নির সন্তান’দের নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করেনি।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কথা আমরা সবাই জানি। দলের নেতার নেতৃত্ব এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে কথিত স্থিতিশীলতার অজুহাতে সংসদ সদস্যরা কেউই স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন না। এমনকি তাঁদের নির্বাচনী এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চাইলেও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া সংসদ সদস্যদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
স্বতন্ত্রদের সঙ্গে বারবার দর-কষাকষির ঝুঁকি এড়াতে তাই রাশ টেনে ধরার ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার মঙ্গলবারেই জানিয়েছে, মনোনয়নবঞ্চিত প্রার্থীদেরও স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগের দলীয় অনুমোদন লাগবে। তাদের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘ঠিক স্বতন্ত্র নয়’ (নট কোয়াইট ইনডিপেনডেন্ট)।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বছরখানেকের কিছুটা বেশি সময়কালে দেশে যত নির্বাচন হয়েছে, এমনকি সংসদের উপনির্বাচন না হলেও তার প্রায় সবই ছিল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াই। দলের মনোনয়নপ্রাপ্ত এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর লড়াই। ব্যতিক্রম হিসেবে কুমিল্লার মেয়র নির্বাচনের কথা হয়তো উঠবে, কিন্তু সেখানে কমিশন যে কতটা অক্ষম অথবা পক্ষপাতমূলক ছিল, তার বিবরণ নতুন করে বলার কোনো প্রয়োজন দেখি না।
এই যে আওয়ামী লীগের ‘আমরা-আমরাই’ অথবা আমরা আর মামুরা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সবচেয়ে বড় নজির ঢাকার পাশে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন। সংসদের উপনির্বাচন, জেলা পরিষদ, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে যে বিদ্রোহী প্রার্থীরা নির্বাচনে জিতেছেন, তাঁদের দলে ফিরতে খুব একটা দেরি হয়নি। আর যাঁরা জিততে পারেননি, তাঁদের অপেক্ষার প্রহর একটু দীর্ঘ হয়েছে। দল থেকে বহিষ্কৃতদের সবার ‘ঘর ওয়াপসি’ সংসদ নির্বাচনের আগেই অবশ্য সম্পন্ন হয়েছে।
স্বতন্ত্রদের সংখ্যাধিক্য হলেও অন্যান্য দলকে নির্বাচনে আনার চেষ্টায় অবশ্য তেমন সাফল্য নেই। তিনটি কিংস পার্টির জন্ম হলো। কিন্তু বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট (বিএনএম), তৃণমূল বিএনপি কিংবা বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি)—কেউই চমক দেখাতে পারছে না।
৩০০ আসনে নামকাওয়াস্তে প্রার্থী দাঁড় করানোর মতো অবস্থাও তারা তৈরি করতে না পারায় তাদের সঙ্গে সব ধরনের লেনদেন পানিতেই গেল বলে মনে হচ্ছে। জেলে নিয়ে চাপ দিয়ে প্রার্থী করাতেও সাফল্য সামান্যই। বিএনপির চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টা ইকরামুজ্জামান, যাঁর রাজনীতিতে ততটা পরিচিতি নেই, যতটা আছে ব্যবসায়। কেবল তিনিই প্রার্থী হচ্ছেন বলে ঘোষণা এসেছে। বাকি যেসব বহিষ্কৃত বা কথিত বিদ্রোহী, তাঁদের সংখ্যা হালির বদলে হয়তো ডজনে হিসাব করা যাবে।
স্মরণ করা যেতে পারে, বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা আওয়ামী লীগের এটাই প্রথম নয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ প্রথম দফায় ক্ষমতায় থাকার সময়ে বিএনপির দুজন সংসদ সদস্যকে মন্ত্রিসভায় জায়গা দিয়েছিল, যা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বৈধ ছিল না। পরে নির্বাচন কমিশন এবং আদালতও সেই রায় দিয়েছিলেন। বিস্ময়কর হলো, তাঁদের দলছুট করায় বিএনপি দুর্বল হয়নি, বরং তার পরের নির্বাচনে তাদের ভোটের হার বেড়ে গিয়েছিল।
ভোটের হারের কথা যদি বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত যেসব দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তাদের সংখ্যা নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনধারী দলগুলোর অর্ধেকের বেশি। তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বাইরে অন্য যেসব দল অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তাদের মধ্যে ইসলামি দলের সংখ্যাই বেশি, যদিও তাদের সংসদে প্রতিনিধিত্বের তেমন কোনো রেকর্ড নেই।
বিপরীতে বিএনপিসহ নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর পাল্লা যথেষ্ট ভারী। কেননা বর্জনের তালিকায় ডানপন্থী ইসলামি দলগুলোর পাশাপাশি বামপন্থীরাও রয়েছে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনগুলোর পরিসংখ্যান বিচার করলে সবচেয়ে কম হলেও বিএনপির ভোটের হার এক-তৃতীয়াংশের কম কখনোই ছিল না।
অতীতে জাতীয় পার্টি থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিতর্কিত নির্বাচনগুলোতেও ভোটের অংশীদার হিসেবে তৃতীয় স্থানটি দখলে নিয়েছে ইসলামী আন্দোলন। নিবন্ধন হারানো জামায়াত এবং বিভিন্ন সময়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), সিপিবির ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ভোটের অংশ যোগ করলে বলা যায়, প্রায় অর্ধেক ভোটারই তাঁদের পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ পাবেন না।
অতীতে সামরিক সরকারের সময়ে আমরা নির্বাচন ঘিরে যেসব কৌশল প্রযুক্ত হতে দেখেছি, সেসব কিছুরই পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাজনীতি আর রাজনীতিকদের হাতে নেই। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হবে। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে এসেছেন গত কয়েক বছরে অবসরে যাওয়া কয়েকজন সচিব, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী। এমন বিরাজনীতিকরণ ও আমলানির্ভরতা সামরিক শাসকেরা চাইলেও তা করতে পারেননি। মনোনয়ন সম্পর্কে বলা হয়, এলাকাভিত্তিক জরিপের ভিত্তিতে যাঁর সম্ভাবনা সবচেয়ে উজ্জ্বল, তাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
জরিপটি কারা করেছে, তা নিয়ে নানা রকম আলোচনা হয়, তবে সবটাই কানাঘুষা। লক্ষণীয় হচ্ছে, জরিপ কিন্তু সরকারের রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রশ্নে নয় বা সরকারের কাজকর্মের রেকর্ডের ওপর নয়, ব্যক্তির প্রভাব কতটা, তার ওপর। ফলে ক্ষমতা ও টাকা আছে যাঁদের, তাঁরাই এগিয়ে গেছেন। কোটিপতি ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা, তারকা খেলোয়াড়, অভিনেতা, অধ্যাপকেরা মনোনয়ন পেয়েছেন। গত এক দশকে যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নই সব নির্বাচনী নাটকের শেষ কথা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেহেতু এটিই প্রত্যাশিত।
প্রসঙ্গত, ক্ষমতাসীন দল তিন দশকের বেশি সময় ধরে উঠতে-বসতে যাদের প্রতিপক্ষ জ্ঞান করেছে এবং এখনো করে, সেই দলটি বিএনপি। আওয়ামী লীগের দাবি, দেশের সব খারাপের দায় বিএনপির এবং সব ভালোর কৃতিত্ব নিজেদের। বর্তমানে যে নজিরবিহীন দমন অভিযান চলছে, তার পেছনেও একই যুক্তি।
বিএনপি যে নির্বাচনের বাইরে রয়েছে, সেটাকে কীভাবে বর্ণনা করা যাবে, তার ভার পাঠকদের। বাস্তবতা হচ্ছে জাতীয় ভিত্তিতে ক্ষমতাসীন দলকে চ্যালেঞ্জ করার মতো রাজনৈতিক বিকল্প ভোটাররা পাচ্ছেন না। আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলনা করলে এটি কম্বোডিয়ার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ