ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। দু-এক দিন বৃষ্টি হলে সেই অজুহাতে দাম বাড়ানো হয়, আবার একনাগাড়ে কিছুদিন বৃষ্টি না হলে সেটাকেও দায়ী করা হয়। ব্যবসায়ীরা এবার আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে ডলারের বাড়তি দাম রাখার দোষ চাপাচ্ছেন ব্যাংকের ওপর।
একাধিক আমদানিকারকের দাবি, ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্র খোলার পর ঘোষিত দরের চেয়ে বাড়তি দামে ডলার কিনে তাদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে বাজারে তেল, চিনি, ডালসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে।
মিলমালিক ও আমদানিকারকেরা গত সপ্তাহে চিনির দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। এরপর ভোজ্যতেলের দামও লিটারপ্রতি ১০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একাধিক আমদানিকারকের দাবি, প্রতি ডলার ১১১-১১২ টাকা ঘোষিত দরে ঋণপত্র খুলে পরিশোধ করতে হচ্ছে ১২৫-১২৭ টাকা হারে। ডলারের বাড়তি দাম রাখার বিষয়ে ব্যাংক কোনো প্রমাণপত্র দেয় কি না জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আমদানিকারক বলেন, ‘ডকুমেন্ট তো অবশ্যই আছে, তবে সেটা কাউকেই দেখানো যাবে না।’
ব্যাংকগুলো সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত বিনিময় হার অনুযায়ী ডলার সংগ্রহ করে তা একই দামে বা ১০ থেকে ২০ পয়সা বেশি দরে আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করে থাকে। কিন্তু আমদানিকারকদের দাবি, বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দাম বেশির ভাগ ব্যাংক মানছে না। তারা বেশি দামে ডলার কিনে আরও চড়া দামে তা বিক্রি করছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্ধারিত দামের চেয়ে দু-এক টাকা বেশি কোনো ব্যাংক নিতে পারে; কিন্তু ১২৩-১২৫ টাকা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। একজন আমদানিকারক বলেন, খাদ্যপণ্য সাধারণত ‘ডেফার্ড এলসিতে’ দেরিতে আমদানি করা হয়। এ ক্ষেত্রে ৯০-১৮০ দিন পর্যন্ত সময় পাওয়া যায়। দেখা যাচ্ছে, আগস্টের শেষ দিকে ১০৯-১১০ টাকায় যে এলসি খোলা হয়েছিল, তা এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে ১১২ টাকায়। এর ফলে প্রতি ডলারে ২-৩ টাকা খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এ জন্য দাম বাড়ানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না।
পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংকের পক্ষে ডলারের বাড়তি দাম রাখার সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি অবশ্য বলেন, ‘ডলার সংকটে পণ্যের গুরুত্ব অনুযায়ী এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই।
তবে সামনে কয়েকটা উৎস থেকে ডলার পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তখন এলসির শর্ত শিথিল করা যেতে পারে। আর ডেফার্ড এলসি নানা কারণে হয়। সেগুলো কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।’
রাজধানীর খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুদিনে ভোজ্যতেলের দাম লিটারপ্রতি ৩-৫ টাকা, চিনির দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা এবং ডালের দাম কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৬৯ টাকা, খোলা তেল ১৪৯ টাকা এবং পাম তেল ১২৪ টাকা। এ ছাড়া চিনির দাম খোলা ১৩০ এবং প্যাকেটজাত ১৩৫ টাকা।
রাজধানীর বনশ্রী বি ব্লকের মেসার্স মোহাম্মদীয়া জেনারেল স্টোরের মালিক আবদুর রহমান বলেন, ‘চিনির দাম গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়েছে। আগে প্রতি কেজি ১৩৫ টাকায় বিক্রি করলেও গতকাল তা ১৪৫ টাকায় বিক্রি করেছি। তিন-চার দিনের ব্যবধানে ডালের দাম তিন টাকা বেড়েছে।’
তিনি জানান, ডিলাররা তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। এটির দাম বাড়বে বলে তাঁরা আশঙ্কা করছেন।
টিসিবির তথ্যমতে, গতকাল শনিবার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৪৫-১৫০ টাকা, বোতলজাত ১৬৮ টাকা, পাম তেলের দাম ১২০-১২৫ টাকা; প্রতি কেজি মসুর ডাল মোটা ১০৫-১১০ টাকা, মাঝারি ১২০-১২৫ টাকা এবং সরু দানা ১৩০-১৩৫ টাকা ছিল।
ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী দুটি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা জানান, ডলারের দাম যে হারে বেড়েছে, তেল-চিনির দাম বাড়ানো ছাড়া তাঁদের বিকল্প কোনো পথ নেই। সে কারণেই সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ টাকা এবং চিনির দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
একজন অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার মাসে লাখ টাকা আয় হয়। নিজের বাড়ি-গাড়ি আছে। এরপরও সংসার চালাতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। যাঁরা কম আয় করছেন, তাঁদের অবস্থা কী হবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।’
পূর্ব রামপুরা বাজারের মুদিদোকানি আরিফুর রহমান বলেন, চিনির দাম লাফিয়ে বাড়ছে। গতকাল চিনি পাইকারি বাজার থেকে প্রায় ১৪০ টাকায় কেনা হয়েছে। এই চিনি খুচরা পর্যায়ে ১৫০ টাকার নিচে বিক্রি করা যাবে না। তাঁর দাবি, এক বস্তা চিনি আনতে পরিবহন খরচ ৬০ টাকা, ক্ষুদ্র পরিমাণে বেচতে গিয়ে কিছু ঘাটতি হয়। এ ছাড়া বস্তার ওজন রয়েছে। এরপর তাঁদের লাভ।
পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ এলাকার ডাল ব্যবসায়ী হাজি ওমর আলী চুন্নু বলেন, মসুর ডাল কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা বেড়েছে। মোটা দানার ডাল গতকাল বিক্রি হয়েছে ১০২-১০৩ টাকায়, মাঝারি ১২-১২৬ টাকা এবং সরু দানার ১৩৫ টাকায়। তবে বাজারে ক্রেতা অনেক কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে এলসি খোলা ধারাবাহিকভাবে কমছে। জুলাই মাসে এলসি খোলা হয়েছিল ৪ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলারের। আগের বছরে তা ছিল ৭ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার। আগস্টে এলসি খোলা হয় ৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারের। আগের বছরে একই মাসে ছিল ৬ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বরে এলসি খোলা হয় ৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের এবং আগের বছর তা ছিল ৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ডলার সংকটে আমদানিতে কড়াকড়ি করায় এলসি খোলা কমেছে। তবু ডলার সংকট থেকে যাচ্ছে। এ জন্য নিষ্পত্তি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় আমদানি পণ্য কমেছে, যা বাজারকে উসকে দিচ্ছে। সংকট কাটাতে শক্তিশালী রাজনৈতিক কমিটমেন্ট দরকার।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ডলারের দাম বাড়লে আমদানি করা পণ্যের ওপর প্রভাব পড়বে। এ জন্য তিনি সাময়িক সময়ের জন্য ডলারের বাজারভিত্তিক দর ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন।
আপনার মতামত জানানঃ