সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতি মৌসুমেই বিভিন্ন সবজির উৎপাদন খরচের হিসাব রাখে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী এক কেজি বেগুন উৎপাদন খরচ ১০ টাকার কিছু বেশি। অথচ বিভিন্ন হাত ঘুরে রাজধানীর খুচরা বাজারে সেই সবজি ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে ১০ গুণেরও বেশি দামে। আকার ও মানভেদে লম্বা ও গোল বেগুন বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি পর্যন্ত। এর কারণ জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা সামনে আনেন নানা অজুহাত।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি কেজি কাঁচা পেঁপে উৎপাদনে ৯ টাকা খরচ হলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। মিষ্টি কুমড়া প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ ৭ টাকা ২২ পয়সা। রাজধানীর বাজারে এ সবজি এখন ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি করলা উৎপাদনে সাড়ে ৯ টাকা খরচ হলেও ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। ১০ টাকা ২৬ পয়সায় উৎপাদিত প্রতি কেজি লম্বা বেগুন ৮০-৯০ টাকা ও গোল বেগুন ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার লাল গোল বেগুনের দাম গিয়ে ১৫০-১৬০ টাকায় ঠেকেছে।
রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ঢেঁড়স ৮০-৯০ টাকা, শসা ৫০-৮০ টাকা, চিচিঙ্গা ও ধুন্দল ৮০, কাঁকরোল ৯০, কাঁচামরিচ ১৬০-২২০, শিম ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি পিস লাউ ৭০-৮০ টাকা, জালি ৫০-৭০, ফুলকপি ৫০ ও বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়। যদিও কৃষি বিপণনের হিসাবে, প্রতি কেজি পটোল উৎপাদনে খরচ হয় ৯ টাকা ৬৯ পয়সা, ঢেঁড়স ১২ টাকা ৪০ পয়সা, শসা ১০ টাকা ৮৪ পয়সা, চিচিঙ্গা ১১ টাকা ৪৭ পয়সা, কাঁচামরিচ ৪০ টাকা ১৭ পয়সা। আর প্রতি পিস লাউ ১৩ টাকা ২০ পয়সা ও জালি উৎপাদনের পেছনে ৯ টাকা ১৯ পয়সা খরচ হয়।
উৎপাদন খরচের সঙ্গে খুচরা বাজারের দামে অনেক বেশি তফাত থাকলেও কৃষকরা এর অংশীদার হতে পারছেন না। বগুড়ার বাজারে প্রতি কেজি শিম ১৮০ টাকায় বিক্রি হলেও কৃষক পাচ্ছেন কেবল ৮০ টাকা। ঠিক একইভাবে খুচরা বাজারে ৮০ টাকায় বিক্রি হওয়া পটোল ৩০ টাকা, ৪০ টাকার পেঁপে ৭-৮ টাকা, ৬০ টাকার লাউ ৩০ টাকা ও ১২০ টাকার বেগুন কৃষক বিক্রি করছেন ৭০ টাকায়।
সবজি উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষকরা বলছেন, খেত থেকে সবজি তুলে পাইকারিতে তারা অল্প দামে বিক্রি করেন। তবে সেটি বিভিন্ন হাত ঘুরে অনেক মূল্য বেড়ে যায়। বগুড়ার সদর উপজেলার আব্দুলপুর ইউনিয়নের কৃষক রবিউল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজারে দেখি সব সবজির আকাশছোঁয়া দাম। কিন্তু আমরা তো এত পাচ্ছি না।’
আবার সবজির পাইকারি থেকে খুচরা বাজারে যেতেই দাম বাড়ে প্রায় দ্বিগুণ। পাইকারিতে প্রতি কেজি শসা ৩২-৪০ টাকায় বিক্রি হলেও খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৫০-৮০ টাকায়। ৬০ টাকার করলা ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অস্বাভাবিক পরিবহন ব্যয়, রাস্তায় চাঁদাবাজি, উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিক্রয় কেন্দ্র পর্যন্ত দফায় দফায় আড়তদারি (কমিশন) খরচসহ নানা ব্যয়ের কারণে সবজির দাম অস্বাভাবিক হচ্ছে।
আবার চলতি অক্টোবরের প্রথম দুই সপ্তাহে বৃষ্টি থাকায় আগাম শীতকালীন সবজি আবাদ বিলম্বিত হয়েছে। বৃষ্টি ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিভিন্ন স্থানের সবজির উৎপাদন। এতে সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। আবার রাজধানীতে সবজি আনতে বিভিন্ন স্থানে বাড়তি চাঁদার কারণেও দাম বেড়ে যায় বলে তারা জানান।
রাজধানীর হাতিরপুল বাজারের ব্যবসায়ী মো. তানভীর হাসান বলেন, ‘আমাদেরই বেশি দামে কিনে আনতে হয়। যে দামে আনি সামান্য লাভে বিক্রি করি। বৃষ্টির কারণে সবজি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ কারণে দাম বেড়েছে বলে শুনেছি।’
বৃষ্টির কারণে সবজির উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু এর অজুহাতে যেভাবে দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলতি ও গত মাসে দুই দফায় টানা বৃষ্টি হয়েছিল। এতে কিছু সবজির উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ কারণে সবজির দাম কিছুটা বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এখন যা দাম তা অস্বাভাবিক। মূলত বৃষ্টি হলেই অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়ে দেন মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ীরা। তারা এ সময়টার জন্যই যেন অপেক্ষায় থাকেন। কৃষক কিন্তু খুব বেশি দাম পান না। উল্টো কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় কোনো একটা ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে পথে বসে যেতে হয়।’
দেশে গত আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, গত সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। সেপ্টেম্বরেও তা ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশে। বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। রাজধানীর মহাখালীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মো. রায়হান। স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মধ্য বাড্ডায়। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মাসে যে বেতন পাই তার অর্ধেক চলে যায় বাসা ভাড়ায়। এরপর গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল আছে। ওষুধের খরচ আছে। বাজারে গিয়ে কী কিনব ভেবে পাই না, সবকিছুর যা দাম! সবজিও এখন কেনা যাচ্ছে না। এভাবে কতদিন চলা যায়? আমার আয় তো আর বাড়ছে না।’
কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘মধ্যস্বত্বভোগীরা নানা অজুহাত দেখিয়ে অতিমুনাফা করছে। কৃষক মুনাফা করতে পারছেন না। কৃষক যদি সরাসরি বাজারে বিক্রি করতে পারলে এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে। কৃষককে দেয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেমন কৃষি ঋণ, প্রণোদনা ভর্তুকি প্রকৃত কৃষকরা পাচ্ছে না। প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিক নেতারা এগুলোতে ভাগ বসাচ্ছেন। যার ফলে কৃষকরা প্রকৃত সুবিধাভোগী হতে পারছেন না। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের পুষ্টি ঘাটতি তৈরি হবে। সবজির যা দাম, মানুষ তো এখন সবজিও খেতে পারছে না।’
আপনার মতামত জানানঃ