ব্যাংকিং খাতে চলমান বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলার সঙ্কটের পাশাপাশি নগদ টাকারো সঙ্কট বেড়ে যাচ্ছে। এ জন্য এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক (কলমানি মার্কেট) থেকে পর্যাপ্ত ধার না পাওয়ায় সঙ্কট মেটাতে কিছু কিছু ব্যাংক প্রতি দিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে দ্বারস্থ হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর চাহিদা মাফিক নগদ টাকার জোগান দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান মতে, গত ১০ অক্টোবর সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে ধার দেয়া হয়েছে ১৩ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। আগের দিন ৯ অক্টোবর ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা এবং ৮ অক্টোবর ১৪ হাজার ১৪ কোটি টাকা ধার দেয়া হয়েছে।
আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নিতে ব্যাংকগুলোকে সোয়া ৭ থেকে সর্বোচ্চ সোয়া ৯ শতাংশ হারে সুদ গুনতে হচ্ছে। তহবিল সঙ্কট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ উচ্চ সুদে ধার নিতে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। আর এ তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় সমন্বয় করতে ঋণের সুদহারও বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
একে তো ডলারের উচ্চ মূল্যে আমদানি ব্যয় বাড়ছে এর ওপর ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। পণ্য উৎপাদনে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে পণ্য মূল্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, টাকার প্রবাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ইতোমধ্যে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। সঙ্কট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধার নেয়ার হার (রেপো) এক সাথে পৌনে ১ শতাংশ সুদ বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সপক্ষে দাবি হলো বাজারে টাকার প্রবাহ কমানোর অন্যতম উপায় হলো নীতি সুদহার বাড়ানো। আর নীতি সুদহার বাড়ানো হলো ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়বে। আর এতে সব ধরনের ঋণের সুদহার বাড়বে। ঋণের সুদহার বাড়লে মানুষ কম ব্যয় করবে। এতে মূল্যস্ফীতি কমে যাবে।
তবে, এর বিপক্ষে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। এটা কার্যকর হয় রফতানি বেশি এমন উন্নত দেশগুলোর জন্য। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি তো আমদানি নির্ভর। রফতানির চেয়ে আমদানি হয় বেশি। যে টুকু রফতানি হয় এর একটি বড় অংশ আবার (তৈরী পোশাক) ব্যাক টু ব্যাক এলসির নামে বিদেশে চলে যায়।
সুতরাং ঋণের সুদহার বাড়লে পরোক্ষভাবে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আর এ ক্ষেত্রে উচ্চ মূল্যের কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়ে যায়। এতে মূল্যস্ফীতি কমে না বরং উসকে দেয়া হয়। একজন ব্যবসায়ী বলেন, ব্যাংকগুলো তাদের চাহিদা অনুযায়ী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য ডলার সংস্থান করতে পারছে না। অনেক সময় প্রতি ডলারের বিপরীতে বেশি ব্যয় করেও চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের এলসি খোলা যায় না।
এতে তাদের উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকও কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এমনিতেই ডলার সঙ্কট এর ওপর ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতি না কমে বরং বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, রেমিট্যান্স ও রফতানির মাধ্যমে যে পরিমাণ ডলার আহরণ করা হচ্ছে, চাহিদা তার চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণে ডলারের দাম বাড়ছে। সিন্ডিকেট ও অতি মুনাফালোভীদের কারসাজির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি বাড়ার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে আরেকটি হলো ডলারের দাম বৃদ্ধি।
সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষ আগের মতো আর ব্যাংকে অর্থ সঞ্চয় করতে পারছে না। বরং অনেকেই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে বাড়তি ব্যয় সমন্বয় করতে জমানো টাকা খরচ করছে। এতে ব্যাংকে কাক্সিক্ষত হারে আমানত বাড়ছে না। আবার ডলার সঙ্কটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নগদ অর্থে ডলার কিনতে হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ৩৭৬ কোটি মার্কিন ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়েছে সাড়ে ৪১ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সা হিসেবে)।
আবার শরিয়াভিত্তিক কিছু ব্যাংকের অনিয়মতান্ত্রিক ঋণ দেয়ার কারণে ওই ঋণ আর ফেরত আসছে না। গত তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) এক সাথে ৩৬টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। সবমিলেই ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার সঙ্কট মেটাতে আন্তঃব্যাংক থেকে টাকা ধার নেয়া হচ্ছে। এতে কলমানি মার্কেটের সুদহারও বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের ৪ অক্টোবর কলমানি মার্কেট থেকে ধার নিতে ৫.৭৯ শতাংশ হারে সুদ গুনতে হতো, গত ২৭ সেপ্টেম্বর তা বেড়ে ৬.৬৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
গতকালও এ সুদহার ৭ শতাংশের উপরে উঠে গেছে। কিন্তু তহবিল সঙ্কটে থাকা ব্যাংকগুলো তাদের চাহিদা অনুযায়ী আন্তঃব্যাংক থেকে ধার পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। কিছু ব্যাংক নিয়মিতই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিভিন্ন মেয়াদে ধার নিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ১০ অক্টোবর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন মেয়াদে ১৩ হাজার ৮৩৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা ধার দিয়েছে। ১৬টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ৭ দিন মেয়াদি রেপোর জন্য ৭ হাজার ৭৯ কোটি টাকা ধার চেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সরবরাহ করেছে ৫ হাজার ৬৬৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
২টি ব্যাংক এক দিন মেয়াদি স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটির আওতায় ১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা ধার চেয়েছিল। পাশাপাশি সরকারের ঋণ দিতে বাধ্য এমন ১২টি ব্যাংক (পিডি ব্যাংক) ৬ হাজার ৬২১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ধার চেয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব ব্যাংকগুলোকেই ওই দিন ব্যাংকগুলোর চাহিদা মোতাবেক ধার দেয়। এ জন্য ৭ দিন মেয়াদি রেপোতে ধার নিতে ব্যাংকগুলোকে ৭.৩৫ শতাংশ, এক দিন মেয়াদি এসএলএফ সুবিধার আওতায় ধার নিতে সোয়া ৯ শতাংশ এবং তারল্য সুবিধার আওতায় ধার নিতে ব্যাংকগুলোকে ওই দিন সোয়া ৭ শতাংশ সুদ গুনতে হয়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, যেভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এটা না কমলে আমানত প্রবাহ আরো কমে যাবে। আর ডলার সঙ্কট না মিটলে ডলারের দাম আরো বেড়ে যাবে। সম্ভাব্য এসব পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করছেন তারা।
আপনার মতামত জানানঃ