বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার ঠাকুরপুর সীমান্তের ভারতীয় ভূখণ্ডে এ ঘটনা ঘটে৷ নিহত রবিউল হক (৪০) দামুড়হুদা উপজেলার পীরপুরকুল্লাহ গ্রামের মৃত রহমত উল্লাহর ছেলে৷
পীরপুরকুল্লাহ গ্রামের বাসিন্দারা জানান, রবিউল হক রাতের আঁধারে অবৈধভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করলে রাঙ্গিয়ারপোতা ক্যাম্প থেকে বিএসএফের সদস্যরা তাকে আটক করে৷ আটকে রেখে নির্যাতন করার এক পর্যায়ে তাকে গুলি করা হলে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান৷
এ ঘটনার পর বিজিবি-বিএসএফ পতাকা বৈঠক করে৷ চুয়াডাঙ্গা-৬ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাঈদ মোহাম্মাদ জাহিদুর রহমান এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন৷
এর আগে গত ১৫ সেপ্টেম্বর চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার বেনীপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মিজানুর রহমান নামের এক ব্যক্তি নিহত হন৷ ৫০ বছর বয়সি মিজানুরের মরদেহ ৭ দিন পর দুই দেশের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ফেরত দেয় বিএসএফ।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাব বলছে, ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে গত সাত বছরে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন ২২১ বাংলাদেশি এবং আহত হয়েছেন আরও প্রায় আড়াই শ। এদের মধ্যে এক বছরেই বিভিন্ন সীমান্তে গুলিতে মারা যাওয়ার পর মরদেহ ফেরত পাওয়া যায়নি ছয়জনের। এর মধ্যে দেশের উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জেরই তিনজন। বাকিগুলো চুয়াডাঙ্গা আর কুড়িগ্রামে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে অথবা নির্যাতনে কেউ মৃত্যুবরণ করলে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর মধ্যে যোগাযোগের (পতাকা বৈঠক) পর লাশ ফিরিয়ে আনা হয়৷ কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমরা জেনেছি যে দীর্ঘদিন ধরে লাশ ভারতে পড়ে থাকলেও সেগুলো আনার ব্যাপারে আমাদের দিক থেকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না৷
নূর খান মনে করেন, ‘‘সংখ্যা যাই হোক না কেন আমি মনে করি বাংলাদেশের একজন নাগরিক সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার হোক বা পৃথিবীর যে-কোনো জায়গায় হত্যা বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটুক, তাদের পরিবার সবসময় চায় যে তারা লাশ পাবে৷’’
তার অভিযোগ, মৃতের প্রতিবার জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য ডকুমেন্ট জমা দেয়ার পরও লাশ আনার উদ্যোগ বিজিবির পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিজিবি তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
নূর খানের মতে, ‘‘জাতীয় পরিচয়পত্র নাগরিকত্ব প্রমাণের সবচেয়ে বড় উপায়৷ তবে নাগরিকত্ব প্রমাণের আরও উপায় আছে৷ কাগজপত্র আমলে না নিয়ে আমাদের নাগরিক না, এটা বলার কোনো সুযোগ বিজিবির দেখি না৷ যদি বলে থাকে, সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং তা তাদের দায়িত্বের সাথে যায় না৷’’
এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যারা মারা যায় তাদের পরিবার জানে যে লাশ সেখানে আছে৷ তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের বাবা-ভাই বা সন্তানের লাশ পেতে চায়, চায় ভারতের সাথে দেন-দরবার করে যেন লাশ আনা হয়, যেন ধর্মীয় বিধান মতে পরিবারগুলো লাশ দাফন করে৷
এদিকে, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় আনার জন্য দুই দেশ অনেকবার আলোচনা করেছে৷ ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা বন্ধ হচ্ছে না৷ তারা সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার কথা বলার পরই আবার সীমান্ত হত্যা শুরু হয়৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে বিএসএফ কর্তৃক নির্যাতন ও গুলিতে ১৭ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন৷ ২০২১ সালে সীমান্তে হত্যা করা হয় মোট ১৯ জন বাংলাদেশিকে৷ এর মধ্যে ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷
২০২০ সালে মোট ৪৮ জন নিহত হয়েছেন৷ গুলিতে ৪২ জন এবং নির্যাতন চালিয়ে ছয় জনকে হত্যা করেছে বিএসএফ৷ অপহরণ করা হয়েছে ২২ জনকে৷ এর আগের বছর ২০১৯ সালে বিএসএফ-এর হাতে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন৷ এরমধ্যে গুলিতে ৩৭ জন এবং নির্যাতনে ছয়জন৷ অপহরণ করা হয়েছে ৩৪ জনকে৷
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় ৯০ ভাগকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে৷ অথচ বাংলাদেশ-ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনায় সীমান্তে মারণাস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহার না করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে গত জানুয়ারিতে জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷
মূলত বন্ধু রাষ্ট্রের গালগল্পের ভীড়ে সীমান্ত হত্যা যেন স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে সীমান্তবর্তী মানুষদের জন্যে। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার সীমান্ত হত্যা বন্ধ আলোচনা এবং চুক্তি হয়েছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনাতেও কোনও সমাধান আসেনি, যার ফলে সীমান্ত হত্যা চলছেই।
সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের বেআইনিভাবে হত্যায় বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি নয়াদিল্লিতে খুবই কম গুরুত্ব পেয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশিকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যের বিবরণ বাংলাদেশকে দেয়নি ভারত। ভারত সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট অনুমোদন না থাকলে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বিএসএফকেও ফৌজদারি কার্যবিধির বাইরে রাখা হয়। বিএসএফ সদস্যদের এমন জবাবদিহিতার বাইরে থাকাই সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ভারত সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া এভাবে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার কথা নয় বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। ভারত সরকার যেহেতু বাংলাদেশকে কৌশলগত বন্ধু হিসেবে তুলে ধরে, সেক্ষেত্রে সীমান্তে হত্যার নির্দেশ কে দিচ্ছে, কিংবা সেই হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কে ভারত সরকারকে বাধা দিচ্ছে বাংলাদেশকে এটা খুঁজে বের করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিই সীমান্তে হত্যার সংখ্যা হ্রাস করতে পারে। গোটা দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা এ প্রশ্নে একমত যে, কেবল ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাংলাদেশের সরকার বাধ্য করতে পারলেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা সম্ভব হতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ