সাধারণত মেয়াদি ঋণ, চলতি মূলধন ইত্যাদি ঋণ নিতে গেলে ব্যাংক জামানত চায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জমি ও ভবনই জামানত হিসেবে গণ্য করা হয়। এর পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জামানত, সঞ্চয়পত্রের সনদ ও ডিপিএসের বিপরীতে ঋণ বিতরণ করে ব্যাংক। তবে সেগুলো ব্যবসায়িক ঋণের বেলায় প্রযোজ্য হয় না। সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী যে পরিমাণ ঋণ নিতে চান, তার চেয়ে বেশি মূল্যের স্থাবর সম্পত্তি জামানত হিসেবে ব্যাংককে দিতে হয়। ফলে ছোট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত জামানতের অভাবে প্রয়োজনীয় ঋণও পান না। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য স্থাবর সম্পত্তির পাশাপাশি অস্থাবর সম্পত্তিও ঋণের জামানত হিসেবে গণ্য করার জন্য আইন করা হচ্ছে। এর ফলে নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীরা সহজেই ঋণ পেতে যাচ্ছেন।
ঋণের বিপরীতে ব্যাংক যেসব জামানত গ্রহণ করে থাকে সেসবের মধ্যে ফিন্যান্সিয়াল অবলিগেশনের (ব্যাংকে জমা হিসেবে রক্ষিত অর্থ অথবা সহজেই নগদ অর্থে রূপান্তর করা যায় এমন আর্থিক সম্পদ) পরেই ব্যাংকারদের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য জামানত হচ্ছে স্থাবর সম্পত্তি (জমি, বাড়ি, দালানকোঠা, ফ্ল্যাট প্রভৃতি)। বন্ধকি জামানত গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে অনিচ্ছুক বা অসমর্থ হলে বন্ধকি জামানত বিক্রি করে ঋণের টাকা আদায় করা। তাই ঋণ প্রদানের আগে ব্যাংকারকে সঠিক ঋণগ্রহীতা যেমন বাছাই করে নিতে হয়, ঠিক তেমনি ঋণের বিপরীতে মূল্যবান, বিক্রয়যোগ্য-নগদায়নযোগ্য এবং বৈধ জামানত গ্রহণ করে ঋণের সেকেন্ড লাইন অব ডিফেন্স তথা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। আর এই নিরাপত্তা শুধু স্থাবর সম্পত্তির বাহ্যিক অবয়ব এবং আর্থিক মূল্য দিয়েই নিশ্চিত হয় না, যদি না তার দলিল-দস্তাবেজ এবং আইনি ভিত্তি সঠিক হয়।
এতসব ঝামেলায় গিয়ে শেষে নতুন উদ্যোক্তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, জামানতের ব্যবস্থা করতে না পারায় শেষে ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা হবার আর জো পায় না। জটিল এবং প্রায় অসাধ্য এসব প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে পারেন না বলে অনেকেই নতুন ব্যবসায় নামতে চান না, আগ্রহ কিংবা শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এসব ক্ষেত্র বিবেচনা করেই ব্যাংক থেকে যেন নতুন ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সহজেই ঋণ পেতে পারেন সেই লক্ষ্যে সরকার আইন করতে যাচ্ছে। যেখানে অস্থাবর সম্পত্তি জামানত হিসেবে বিবেচনা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এই আইনের খসড়া তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ মতামত চেয়ে খসড়া আইন তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রচলিত ঋণ ব্যবস্থায় অস্থাবর সম্পত্তিকে জামানত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আরও বেশি মানুষের কাছে ঋণ সহজলভ্য করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা আমানতের সনদপত্র, কার্যাদেশ বা ওয়ার্ক অর্ডার, সোনাদানার মতো ১০ ধরনের অস্থাবর সম্পত্তি ঋণের জামানতের জন্য বিবেচনা করা হবে।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, রপ্তানি পণ্য তৈরির কাঁচামালের যথাযথ নথিপত্র থাকলে তা ঋণের জামানত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকা আমানতের সনদপত্রও জামানত হিসেবে বিবেচিত হবে। স্বর্ণ, রৌপ্য ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু, যার ওজন ও বিশুদ্ধতার বিষয়ে স্বীকৃত কর্তৃপক্ষের সনদ আছে, তাও জামানত হিসেবে রাখা যাবে। নিবন্ধিত মানসম্পন্ন কম্পানির শেয়ার সার্টিফিকেট, মেধাস্বত্ব অধিকার এবং কার্যাদেশ জামানত হিসেবে বিবেচনা করা যাবে। এছাড়া আসবাবপত্র, ফলদ ও ঔষধি গাছ, ইলেকট্রনিক পণ্য, সফটওয়্যার, অ্যাপস যার মূল্য হিসাব করা যায়, সেগুলো ঋণের জামানত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। যান্ত্রিক বা অযান্ত্রিক যানবাহন ও খনিজসম্পদ জামানত হিসেবে গণ্য হবে। এ ছাড়া যথাযথভাবে সংরক্ষিত কৃষিজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত মৎস্য বা জলজ প্রাণী এবং আয় উৎসারী জীবজন্তু জামানতের জন্য বিবেচিত হবে।
নভেল করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে দেশের নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, কৃষক ও প্রান্তিক/ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাদের আয় উৎপাদন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছেন না। এক্ষেত্রে সরকার যদি নতুন ব্যবসায়ীদের ঋণ পাবার ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, এতে অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী নতুন ব্যবসায়ের দিকে আগ্রহ বাড়াবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, করোনার কারণে অনেকেই কাজকর্ম হারিয়ে দিশেহারা অবস্থায় আছেন। কেউযে নতুন কিছু করার আগ্রহ দেখাবে তেমনও পুঁজিবাট্টা নেই তাদের। এক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণ পাবার জটিলতায় অনেকেই যেতে চান না। অনেকের স্থাবর সম্পত্তি নেই বলেও এবিষয়টা ভাবেনও না। এসব ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পাবার আইন দেশের অনেক কর্মহীন লোকদের অবলম্বন ফিরে পাবার আশা ব্যক্ত করেন সংশ্লিষ্টরা।
এসডাব্লিউ/ডিএস/কেএইচ/১৫০৩
আপনার মতামত জানানঃ