দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্স। ডলার সংকটের এ সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো সেই আয়ের কদর আরো বেড়েছে। প্রণোদনা দিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়ানোর চেষ্টা করছে সরকার।
তবে তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুলাইয়ে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় জনশক্তি রফতানি ৬৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ বাড়লেও রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। দক্ষতার ঘাটতি, আয় কমে যাওয়া, বিনিময় হারে পার্থক্যের কারণে ব্যাংক খাতের প্রতি প্রবাসীদের আস্থাহীনতা ও হুন্ডি-হাওলার দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে এমনটি ঘটে থাকতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিসংখ্যান কী বলছে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বিষয়ে প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, দেশ থেকে গত জুলাইয়ে ১ লাখ ২৫ হাজার ৮৫০ কর্মী বিদেশ গেছেন। ২০২২ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ৭৫ হাজার ৪৯৯। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে জুলাইয়ে জনশক্তি রফতানি বেড়েছে ৬৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
তবে রেমিট্যান্স ৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ কমেছে। গত বছরের জুলাইয়ে দেশে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। চলতি বছরের একই সময়ে তা কমে ১৯৭ কোটি ৩২ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
শুধু জুলাই নয়, চলতি বছরের জুন ও মে মাসেও আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি কর্মী গেছে বিদেশে। এর মধ্যে গত জুনে ১ লাখ ১৪ হাজার ১৭৫ ও মে মাসে বিদেশে গেছেন ১ লাখ ১ হাজার ৫৫৮ জন। যেখানে ২০২২ সালের জুন ও মে মাসে বিদেশে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১ লাখ ১১ হাজার ৫৩৯ ও ৭৭ হাজার ৪২১ জন। এর বিপরীতে গত বছরের জুনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮৩ কোটি ৭৩ লাখ ডলার।
আর চলতি বছরের জুনে ২১৯ কোটি ৯১ লাখ ডলার এসেছে। গত বছরের মে মাসে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। চলতি বছরের একই সময়ে এসেছে ১৬৯ কোটি ১৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স। সে হিসাবে আগের বছরের মে মাসের তুলনায় চলতি বছরের একই মাসে বিদেশে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ৩১ শতাংশ বাড়লেও রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমেছে ১০ শতাংশ।
তবে গত জুনে জনশক্তি রফতানির চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ রেমিট্যান্স বেড়েছে। মূলত মাসটির শেষ সপ্তাহে ঈদুল আজহার কারণেই দেশে থাকা স্বজনদের কাছে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
জানতে চাইলে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক ড. সি আর আবরার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জনশক্তি রফতানি ও এর বিপরীতে প্রাপ্ত রেমিট্যান্স একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক রয়েছে। তার পরও এখানে অনেকগুলো ফ্যাক্টর নানাভাবে কাজ করে।
শ্রমিক বিদেশ যাওয়ার পর তার বেতন কত, যে পরিমাণ জনশক্তি রফতানি হয়েছে তার বিপরীতে কতসংখ্যক মানুষ রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছে, তারা যে ঋণ করে বিদেশ গেছে সেটা তারা পরিশোধ করতে পারছে কিনা এসব বিবেচনায় নিতে হবে। আর এগুলো পরিষ্কার হলেই আমরা পরবর্তী বিষয় সম্পর্কে জানতে পারব।’
সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশ থেকে ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৯৩১ কর্মী বিদেশে গেছেন। এর বিপরীতে ২ হাজার ১৬১ কোটি ৭ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। আগের অর্থবছরে বিদেশ গিয়েছিলেন ৯ লাখ ৮৮ হাজার ৯১০ জন, রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ ডলার। সে হিসাবে জনশক্তি রফতানি বাড়লেও সে তুলনায় রেমিট্যান্স আসছে না দেশে।
অন্যতম সমস্যা হুন্ডি
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বিশেষ করে ডলারের বিনিময় হারে পার্থক্যের কারণে হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসী আয়ের অর্থ আসা বেড়ে গেছে। এমনকি সরকারের প্রণোদনার চেয়েও হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠালে বেশি লাভ পান প্রবাসীরা।
এক্ষেত্রে বিনিময় হারকে একীভূত ও বাস্তবসম্মত করতে না পারার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায় রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের জুলাই শেষে দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। চলতি বছরের জুলাই শেষে এ হার দাঁড়িয়েছে ১০৯ টাকায়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যল্লল বলেন, ‘জনশক্তি রফতানি বাড়ার সঙ্গে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি একটু সময়ের ব্যবধানে হয়। কিন্তু পরিসংখ্যানে যে পরিমাণ কম দেখাচ্ছে সেটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
ধারাবাহিকভাবে যদি এ পার্থক্য থেকে যায় তাহলে সময়ের ব্যবধানের বিষয়টি আর প্রাসঙ্গিক থাকে না। এখানে দুটো বিষয় আছে। একটি হচ্ছে যারা বিদেশে যাচ্ছে তারা কি আগের চেয়ে কম আয় করার ফলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছে না? আরেকটি হচ্ছে বিদেশে যাওয়ার খরচ পূরণের জন্য সেখানে তারা বড় কোনো ঋণ করেছে কিনা।
কারণ বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মী পাঠানোর খরচ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। এটি হচ্ছে সরবরাহ দিকের বিষয়। অন্যদিকে জোগানের বিষয়ে বলতে গেলে বিনিময় হারে পার্থক্যের কারণে তারা হয়তো ব্যাংকের মাধ্যমে না পাঠিয়ে হুন্ডিতে টাকা পাঠাচ্ছে।’
দেশ থেকে বিদেশে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধান, কর্মীদের অধিকার সংরক্ষণ ও প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। জনশক্তি রফতানি বাড়লেও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএমইটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, জনশক্তি রফতানির তুলনায় রেমিট্যান্স কমে আসার বেশকিছু কারণ রয়েছে। এগুলো শুধু একটা সুনির্দিষ্ট কারণের ওপর নির্ভর করে না। শ্রমিকদের দক্ষতা তার মধ্যে একটি। এর ওপর নির্ভর করে তারা কী পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠাতে পারবেন। একজন শ্রমিক বিদেশ যাওয়ার পরও যদি দক্ষতার অভাবে আয় করতে না পারেন তাহলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না।
বিদেশ গিয়ে তাদের আয় হচ্ছে তা নিজের ব্যয় চালাতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। দুই ঈদের সময় শ্রমিকরা কষ্ট করেন, খেয়ে না খেয়ে স্বজনদের জন্য অর্থ পাঠান। ফলে ঈদের মৌসুমে আমাদের রেমিট্যান্সের প্রবাহ প্রবৃদ্ধির দিকে থাকে। ঈদের পর তা আবার কমে যায়। তাছাড়া বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোর ওপর অনাস্থা রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ।
শ্রমিকরা অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ব্যাংক খাতে না পাঠিয়ে হুন্ডি-হাওলায় পাঠাচ্ছেন। তবে দক্ষ জনবল তৈরি, শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেয়াসহ বিএমইটির কার্যক্রম নিয়মিতভাবে চলছে।
এসডব্লিউএসএস/১৩১৫
আপনার মতামত জানানঃ