প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজনের বেশি ডেঙ্গু রোগী আসছেন হাসপাতালে। ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ১০টি সুপারিশ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বহুপক্ষীয় উদ্যোগ ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। মানুষের সচেতন আচরণ ও নাগরিক সমাজের সম্পৃক্ততা জরুরি হয়ে পড়েছে।
গতকাল সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদিনে আরও ১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আগস্টে মৃত্যুর সংখ্যা ১১৩ জন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৬৪ জনে। দেশে ইতিমধ্যে ডেঙ্গু রোগী মৃত্যুতে পুরনো রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড সংখ্যক ২ হাজার ৯৫৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মৃত ৩৬৪ জনের মধ্যে নারী ২০৪ জন এবং পুরুষ ১৬০ জন। মোট মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ৮১ জন এবং রাজধানীতে ২৮৩ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২ হাজার ৯৫৯ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১ হাজার ৯৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৮৬২ জন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ২ হাজার ৯৫৯ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৭৯০ জনে।
ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৪ হাজার ৪৬০ জন এবং ঢাকার বাইরে ৫ হাজার ৩৩০ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ৭৮ হাজার ২৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি রোগীর মধ্যে পুরুষ আক্রান্ত ৪৯ হাজার ১৩৬ জন এবং নারী ২৮ হাজার ৮৯২ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৬৭ হাজার ৮৭৪ জন।
অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫৬ জন এবং মারা গেছেন ৩৪ জন।
জুলাইতে শনাক্ত ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন এবং মারা গেছেন ২০৪ জন। আগস্টের ১০ দিনে ২৬ হাজার ১৯৬ জন শনাক্ত এবং প্রাণহানি ১১৩ জনের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ অনেক ডেঙ্গু রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন, তাদের হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই।
প্রতিরোধে ১০টি সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা: ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ১০টি সুপারিশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বহুপক্ষীয় উদ্যোগ ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। পরিস্থিতির উন্নতি করতে মানুষের সচেতন আচরণ ও নাগরিক সমাজের সম্পৃক্ততা জরুরি হয়ে পড়েছে।
গতকাল রাজধানীর মহাখালীর নিপসম মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ: সামনে করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে তারা এসব কথা বলেন। পাবলিক হেলথ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এই সেমিনারের আয়োজন করে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ছাড়াও সেমিনারে সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ববিদ, টিকা বিশেষজ্ঞ, সাধারণ চিকিৎসক, গবেষক, সাংবাদিক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারের আয়োজকদের পক্ষ থেকে ১০টি সুপারিশ বা করণীয় উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে আছে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ানো, পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৌশলগত অগ্রাধিকার ঠিক করা, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় দক্ষতা বাড়ানো, হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনায় সৃজনশীল উদ্যোগ, মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা চালু, মশারি বিতরণ, মশার ওপর নিয়মিত নজরদারি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গোটা সরকার ব্যবস্থার সম্পৃক্ততা এবং জোরালো তদারকি ও নিয়মিত কাজের মূল্যায়ন।
সেমিনারে তিনটি অংশ ছিল: দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন, প্যানেল আলোচনা এবং মুক্ত আলোচনার পাশাপাশি প্রশ্ন করার সুযোগ। প্রথম প্রবন্ধ উপস্থাপনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি নানা পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করা জরুরি। নির্বাচনের কারণে ডেঙ্গু ইস্যুটি পেছনে পড়ে গেছে। এতে দুর্যোগ আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।
বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, করোনার সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল। বর্তমানে ডেঙ্গু জাতীয় জরুরি অবস্থার মতো। দ্বিতীয় উপস্থাপনায় নিপসমের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, মশানাশক ও লার্ভানাশ কার্যকারিতা হারিয়েছে। মশককর্মীরা যেভাবে কাজ করছেন, তাতে আবাসিক এলাকায় মশা বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি আছে।
প্যানেল আলোচনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ২০ ধরনের অংশীজনকে নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে পাঁচ কোটি মানুষের কাছে সচেতনতামূলক বার্তা গেছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, দেশে রাজনৈতিক কারণে একাধিকবার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যের ব্যাপারে জরুরি অবস্থা ঘোষণা হতে দেখা যায়নি। জরুরি অবস্থার জন্য হাজার হাজার মানুষ মারা যেতে হবে, বিষয়টি তেমন নয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পাবলিক হেলথ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক শাহ মনির হোসেন। এতে আরও বক্তব্য রাখেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এস এম শহিদুল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক নিজাম উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রধান কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান।
এসডব্লিউএসএস/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ