প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রাচুর্যে ভরপুর বিশ্বে অনন্য হালদা নদী বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছে। দখল-দূষণে বৈশিষ্ট্য হারানো এ নদীর পাড় ঘেঁষে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে তৈরি হচ্ছে ভারতের অর্থনৈতিক অঞ্চল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর নামক এ অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করেছে দেশটির বৃহত্তম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপ। আগামী ২৬ মার্চ ২০২১-এর মধ্যেই এ সংক্রান্ত চুক্তি সই হওয়ার কথা রয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে নতুন করে সংকটাপণ্ন হয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম প্রাকৃতিক প্রাচুর্যময় হালদা নদী।
বিভিন্ন স্থাপনা ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা এরইমধ্যে আক্রান্ত। ভারতের অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় সে নদী থেকে উত্তোলন হবে বিপুল পরিমাণ পানি। শুস্ক মৌসুমে প্রতি সেকেন্ডে ৩ দশমিক ৭ কিউসেক হারে পানি উত্তোলন করা হবে হালদা থেকে। যার অর্থ, ঘণ্টায় প্রায় ৩৮ লাখ লিটার পানি উত্তোলন হবে এ নদী থেকে। বলা হচ্ছে, শুস্ক মৌসুমে গড়ে প্রতিদিন সব মিলিয়ে উত্তোলিত হবে প্রায় ১৪ কোটি লিটার পানি। তাছাড়া বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করার লক্ষ্যে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের জন্য জেটি নির্মাণেরও তাগিদ দিচ্ছে আদানি গ্রুপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের উদ্যোগে আরও বিপন্ন করে তোলা হচ্ছে হালদার প্রাণ।
লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, “হালদা নদী পৃথিবীর ঐতিহ্য। যেখানে জোয়ার-ভাটাতেও মিঠা পানি। অপরিকল্পিত বাঁধ, শিল্পকারখানা, বর্জ্য অব্যবস্থাপনা, ক্ষতিকর চাষসহ নানা দূষণে দূষিত হয়ে কমেছে পানি। শুধু মাছই নয় এখানে অনেক জলজ প্রাণী রয়েছে। অনেক শুশুক মারা যাচ্ছে। সেখানে আমাদের পানি নিরাপদ করতে হবে, পানি উত্তোলন বা আর কোন ক্ষতি নয়। নদীর প্রাচুর্য বাড়াতে হবে। নদীর সাথে দুর্ব্যবহার নয়।”
শুরুতে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ৪৬০ একর ও বাগেরহাটের মোংলায় ১১০ একর জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার আগ্রহ দেখিয়েছিলো ভারত। তবে এই দুই প্রকল্পে আর আগ্রহ নেই ভারতের। ২০১৭ সালের ভারতের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বাংলাদেশ সফরে এলে তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) সই হয়। এরপর থেকেই কাজ শুরু হয় মিরসরাইকে ঘিরে। এনিয়ে বেজার সঙ্গে আদানির সমঝোতা স্মারক সই হয় ২০১৯ সালে। এরপর এই দুই উন্নয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন পায় আদানি।
বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় দেশটির ৭৫০ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। বেজা জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় ভারতের কাছ থেকেই ঋণ পাওয়া যাচ্ছে সাড়ে ১১ কোটি ডলার। প্রায় ১০ বছর ধরে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি বজায় রেখেছে ভারত। তবে ঢাকা-নয়াদিল্লির সাম্প্রতিক নানা শীর্ষ বৈঠকে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন ও দ্রুত অর্থ ছাড়ে আলোচনা জোরালো হয়।
১৭ ডিসেম্বর ২০২০, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে এ নিয়ে তাগিদ দেয়া হয় ঢাকার পক্ষ থেকে। এর পরপরই চুক্তি সইয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে দু’পক্ষ। সম্প্রতি এ অঞ্চল নির্মাণের জন্য স্থানও চূড়ান্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের জোন-১৯ চূড়ান্ত করার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হয়েছে। জেটি নির্মাণের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে আদানি গ্রুপ। এক্ষেত্রে অনুমোদন দিবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। বিষয়টি দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চলছে। জেটি নির্মাণের অনুমতি পেলেই অঞ্চলটি উন্নয়নের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেবে আদানি গ্রুপ।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী জানান, “বর্তমান সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে বিনিয়োগের আদর্শ স্থান হিসেবে পরিচিত হবে বাংলাদেশ।”
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে প্রতিবেশী ভারতের অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় যেমন তৎপরতা চলছে, তেমনি দুশ্চিন্তা বেড়েছে হালদা নদীকে ঘিরেও। ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের কাজটি দ্রুত শুরু হওয়ার তৎপরতা শুরু হয়েছে দু’ পক্ষ থেকেই। এই পরিস্থিতিতে, সকল আশঙ্কা নাকচ করে শনিবার চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য পানি উত্তোলন করা হলে তাতে মাছের প্রজননের কোনো সমস্যা হবে না। আরও বলেন, ভ্রান্ত ধারণায় উন্নয়ন যাত্রা ব্যাহত হলে দেশের মানুষকে এর মূল্য দিতে হবে। তাই বিভ্রান্তি না রাখার আহ্বান মন্ত্রীর।
[zoomsounds_player artistname=”লেখক ও গবেষক” songname=”গওহার নঈম ওয়ারা বলেন” type=”detect” dzsap_meta_source_attachment_id=”3958″ source=”https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/01/গওহার-নঈম-ওয়ারা.mp3″ thumb=”https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/01/গওহার-নঈম-ওয়ারা.png” config=”default” autoplay=”off” loop=”off” open_in_ultibox=”off” enable_likes=”off” enable_views=”off” enable_rates=”off” play_in_footer_player=”default” enable_download_button=”off” download_custom_link_enable=”off”]
তবে গওহার নঈম ওয়ারা’র মতে, এনিয়ে জেনে-বুঝে কথা বলতে হবে, এটি কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কথা না। নদীকে নদীর মতো থাকতে দিতে হবে , সেটাই মূল কথা। বিশেষ করে হালদার মতো নদী যেটা এত সম্পদশালী। এটায় আমাদের হাত দেয়া উচিত না। আমাদের হাতে অনেক ময়লা। সে ময়লা হাতে ধরা যাবেনা। এতো গায়ের জোরে হচ্ছে। এটা বলার কিছু নাই। এনিয়ে কোন গবেষণা নাই। কে করেছে গবেষণা?”
বিশ্বে মিঠা পানির মাছের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে অন্যতম হালদা । বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যেখানে প্রাকৃতিক উৎসের মাছ কমে যাচ্ছে, সেখানে প্রজননক্ষেত্র হিসেবে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। হালদা নদীর প্রাণ রক্ষার সরকার কোনো সঙ্কট না দেখলেও বিশেষজ্ঞরা ঠিকই সংশয় প্রকাশ করেছেন। সরকারের এ অবস্থায় উচিত নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে এ বিষয়ে তদন্ত চালানো। প্রাণ-প্রকৃতিবান্ধব হলে অর্থনীতি টেকসই হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডাব্লিউ/এসআর/আরা/১০৪০
আপনার মতামত জানানঃ
![Donate](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/06/xcard.jpg.pagespeed.ic.qcUrAxHADa.jpg)
আপনার মতামত জানানঃ