প্রস্তর যুগকে মানব বিবর্তনের একটা মুখ্য ধাপ ভাবা হয়। তবে আমরা, মানুষরাই যে একমাত্র প্রজাতি যারা প্রস্তর যুগের মধ্য দিয়ে গিয়েছি তা কিন্তু নয়! কলিন বাররাসের বিবিসি নিউজের আর্টিকেল থেকে জানা যায়, পশ্চিম আফ্রিকার রেইনফরেস্টে, ব্রাজিলের জঙ্গলে আর থাইল্যান্ডের সমুদ্রতটে প্রত্নতত্ত্ববিদরা পাথুরে হাতিয়ার খুঁজে পেয়েছেন। এগুলো দেখতে তেমন বিশেষ কিছু নয়। হয়তো প্রথম দেখাতে আপনি বুঝতেও পারবেন না এগুলো যে হাতিয়ার। বয়সেও এদের কোনো বিশেষত্ব নাই- সর্বোচ্চ পিরামিডের সমবয়সী হতে পারে এই হাতিয়ারগুলো।
যে বিষয়টা এগুলোকে বিশেষ বানিয়েছে তা হচ্ছে কোনো মানুষের হাত এগুলোকে ব্যবহার করেনি! Chimpanzees, Capuchins আর Macaques বানররা এই হাতিয়ারগুলোর আবিষ্কারক আর ব্যবহারকারী। বিজ্ঞানের নতুন শাখা প্রাইমেট প্রত্নতত্ত্ব ব্যবহার করে এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো বের করা হচ্ছে এবং হয়েছে।
এই হাতিয়ারগুলো খুব অযত্নে বানানো। শিম্প আর বানরের বানানো এসব হাতিয়ার মানুষের বানানো হাতিয়ারের তুলনায় নস্যি। কিন্তু মূল বিষয় সেটা না। এই প্রাইমেটরা হাতিয়ার বানানোর সংস্কৃতি শুরু করেছে, আর এর মানে এটাই যে তারা প্রস্তর যুগে প্রবেশ করেছে।
কয়েক যুগ আগে বিজ্ঞানীরা ভাবতেন শুধু মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা হাতিয়ার বানাতে এবং ব্যবহার করা শিখেছে। হয়তো এই ভাবনার দিন শেষ। আমরা এখন প্রমাণলব্ধভাবে জানি যে অনেক স্তন্যপায়ী, পাখি, মাছ এমনকি পতঙ্গও কাজে সহায়ক “হাতিয়ার” ব্যবহার করছে। এই জ্ঞান লাভ করার ফলে ওদের জীবন আরও সহজতর হয়েছে।
অনেক প্রাইমেটও এখন হাতিয়ার ব্যবহার করছে। যেমন ২০১৪ সালে গরিলাকে দেখা গেছে গাছের ডাল ব্যবহার করে পিঁপড়াদের ঢিবি থেকে বের করে আনছে। কিন্তু প্রাইমেটদের পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করার ইতিহাস নেই, এটা যেন অলিখিত একটা নিয়ম ছিল।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রিমার্চ প্রজেক্টের প্রধান মাইখেল হাসলাম বলেন, “ওরাং-ওটান, বোনোবো, আর গরিলারা যদিও গাছের ডাল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শিখেছে, তাদের পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করতে দেখা যায় নি।”
ঠিক কি এই কারণেই আমাদের পূর্বপূরুষরা (great apes) হাতিয়ার কম করতো জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “আশেপাশে হয়তো এত পাথর ছিল ওদের ব্যবহারের জন্য। গাছে বেঁচে থাকা প্রাণীদের জন্য পাথর খুব একটা সহজলভ্য বস্তু না।”
পাথরের দূলর্ভ হওয়া হয়তো গ্রেট এপদের হাতিয়ার না বানানো আর বংশানুক্রমে এই ঐতিহ্য শুরু না করার প্রধান কারণ।
যাই হোক, পশ্চিম আফ্রিকার শিম্পাঞ্জিরা তাদের পাথুরে হাতিয়ার বানানোর পরম্পরা বংশানুক্রমে বয়ে নেওয়ার পথ খুঁজে নিয়েছে, যা দিয়ে শক্ত খোলস বিশিষ্ট ফল যেমন-বাদাম এমনকি নারিকেল ভাঙ্গার জন্য ব্যবহার করা যায়।
২০০৭ সালে প্রকাশিত প্রিম্যাচ এর পেপার তাই বলে। মানুষের প্রত্নতাত্ত্বিক জ্ঞান নির্ভর করে প্রাচীন মানুষের আচার-আচরণ জানার উপর- তাদের ব্যবহৃত জিনিস সম্পর্কে জানার উপর। সাধারণ দর্শকের কাছে যেটা বর্জ্য, একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রত্নতত্ত্ববিদের কাছে সেটা হয়তো তথ্যের বিরাট ভাণ্ডার।
লিপজিখ, জার্মানীতে অবস্থিত ম্যাক্স প্ল্যাংক ইন্সটিটিউট ফর এভ্যুলুশনারি এন্থ্রপলোজি এর ক্রিস্টোফি বয়েসেছ এর তত্ত্বাবধানে থাকা প্রাইমেট প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ শিম্পাঞ্জিদের বানানো এইসব হাতিয়ার খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
আইভরি কোস্টের রেইন ফরেস্টে ভূ-পৃষ্ঠের ১ মিটার নিচে পাথরের তৈরি ৪,৩০০ বছর আগের জিনিস খুঁজে পেয়েছেন। এগুলোর কিছু এতোই নিখুঁত যে এগুলো মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর পক্ষে বানানো অসম্ভব। তবে কিছু হাতিয়ার অযত্নের সাথে বানানো আর ব্যবহৃত- ঠিক যেমন করে বর্তমান সময়ের শিম্পাঞ্জিরা অযত্নের সাথে হাতিয়ার বানাচ্ছে আর ব্যবহার করছে।
ক্রিস্টোফি আর তার সহকর্মীরা এর আগে এই এলাকার শিম্পাঞ্জিদের এসব হাতিয়ার নিয়ে কাজ করছিলেন। তাদের এই কাজ থেকে শিম্পাঞ্জিদের এইসব হাতিয়ার ব্যবহার করার নিয়মতান্ত্রিক পথের আভাস পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে, শিম্পাঞ্জিদের ভারী হাতুড়ি জাতীয় ব্যবহার করার প্রতি ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়। মানুষ, একই ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম ভারী হাতুড়ি ব্যবহারে অভ্যস্ত। এসব পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে এসব হাতিয়ার শিম্পাঞ্জিদের বানানো এবং ব্যবহৃত।
শিম্পাঞ্জিরা এইসব হাতুড়ি এমন কিছু শক্ত খোলস বিশিষ্ট ফল ভাঙ্গার জন্য ব্যবহার করেছে যেগুলো মানুষের খাদ্য নয়। হাতুড়ির গায়ে লেগে থাকা শর্করা সেই দিকেই ইঙ্গিত করে। সব মিলে এই হাতিয়ারগুলো আমাদের বলছে শিম্পাঞ্জিরা কমপক্ষে ৪,৩০০বছর ধরে পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করে আসছে। শিম্পাঞ্জিদের প্রস্তরযুগ খুব জলদি শুরু হয়েছে, মনে করেন ক্রিস্টোফি, তবে তিনি বলেন, “এর আগের ধাপগুলোর নিদর্শন ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে তা বলা মুশকিল।”
তাত্ত্বিকভাবে বলা যায় শিম্পাঞ্জিদের প্রস্তর যুগ অনেক জলদিই শুরু হয়েছে। শিম্পাঞ্জিরা আমাদের নিকটতম আত্নীয়, তাদের হাতিয়ার বানানোও আমাদের এক পূর্বপূরুষের দিকেই ইঙ্গিত করে, যারা সর্বপ্রথম পাথরের হাতিয়ার বানাতে সক্ষম হয়েছিল।
হাসলাম-এর মতে ব্যাপারটা অসম্ভব। তাই যদি হতো তবে সকল শিম্পাঞ্জিই হাতিয়ার বানানোর কথা, কিন্তু সেটা করেছে পশ্চিম আফ্রিকার কিছু গোত্রের শিম্পাঞ্জি। সবচেয়ে যৌক্তিক অবস্থান হচ্ছে – পশ্চিম আফ্রিকার শিম্পাঞ্জিরা যখন পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকান শিম্পাঞ্জিদের গোত্র থেকে আলাদা হয়েছে তার পর এরা হাতিয়ার বানানো শিখেছে।
হাসলাম বলেন এটা ঘটেছে ৫,০০,০০০ থেকে ১ মিলিয়ন বছর আগে। এখন মনে হচ্ছে পশ্চিম আফ্রিকার শিম্পাঞ্জিদের পাথুরে হাতিয়ার মানুষের তৈরি পাথুরে হাতিয়ার থেকে আলাদা।
কয়েকশতক আগের রিপোর্টেও দেখা যায় ব্রাজিলের Capuchins (Sapajus libidinosus) পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করছে। ২০০৪ সালের এক রিপোর্ট সেটা নিশ্চিত করে। থাইল্যান্ডের লম্বা লেজের বানররাও (Macaca fasciwlaris aurea), ২০১৫ সালের মে মাসের এক রিপোর্ট অনুযায়ী একই কাজ করছে বলে জানা যায়। এই দুই প্রজাতির কোনোটিই মানব বিবর্তনের শাখা প্রশাখায় খুব একটা কাছের আত্নীয় না।
Capuchins আমাদের থেকে ৩৫ মিলিয়ন বছর আগে আলাদা হয়ে যায়, ওদের নতুন পৃথিবীর বানর বলা যায়। হাসলাম বলেন, “এমনকি Macaques আমাদের শাখা থেকে ২৫ মিলিয়ন বছর আগে বের হয়ে যায়।”
অন্যভাবে বলতে গেলে প্রস্তর যুগের প্রাইমেটরা বিবর্তনের শাখা-প্রশাখায় এতোই বিস্তৃত যে ক্রমান্বয়ে সকল প্রজাতিই স্বকীয়ভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা শিখে যেত।
মূলত বানরের এই দুই প্রজাতিই হাতিয়ার বানানোর তথ্য প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। এর মানে দাঁড়ায় মানুষ ব্যতীত আরও তিনটি প্রজাতির পাথুরে হাতিয়ার বানানোর তথা পরিচালনা করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। শিম্পাঞ্জি আর বানরের বানানো এইসব হাতিয়ার সরল গঠন সম্পন্ন, মানুষের বানানো প্রথম হাতিয়ারগুলোও সরল গঠন সম্পন্নই ছিল।
সম্ভবত শিম্পাঞ্জি ও বানরদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার সীমায় পৌঁছায় নি। এটাও পরিষ্কার না যে ওরা প্রস্তর যুগ থেকে এগোতে পারবে কি না। আমরা ওদের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছি, ওদের বাসস্থান ও শিকার করার জায়গা ধ্বংস করে দিচ্ছি…সংখ্যায় কম হওয়ায় ওরা বড় গোত্রের মত ছড়িয়ে যেতে পারে না, জটিলতর প্রযুক্তির দিকে যেতে পারে না।”
অন্য কথায় বলতে গেলে, শিম্পাঞ্জি আর বানরদের এর চেয়ে জটিলতর হাতিয়ার বানানোর ক্ষমতা আছে, কিন্তু তারা কখনোই সেই পর্যায়ে যেতে পারবে না কারণ প্রাইমেট-দের আরেক গোত্র (মানুষ) পাথুরে হাতিয়ার বানানোর ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ