মানুষের মস্তিষ্কের কোষের শক্তিতে চলবে কম্পিউটার। এত দিন কেবল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতেই এ কথা শোনা যেত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষক এ ধরনের যন্ত্র নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন।
তারা ক্ষেত্রটির নাম দিয়েছেন ‘অর্গানয়েড ইনটেলিজেন্স’ বা কৃত্রিম অঙ্গসদৃশ বুদ্ধিমত্তা। গবেষকেরা দাবি করছেন, তাঁদের এই গবেষণা কম্পিউটারপ্রযুক্তির ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে।
তারা এই বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে ‘জৈব কম্পিউটার’ তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন।
অর্গানয়েড হলো অঙ্গসদৃশ পরীক্ষাগারে তৈরি কোষ। ত্রিমাত্রিক অঙ্গকাঠামোগুলো সাধারণত স্টেম সেল নামের বিশেষ কোষ থেকে তৈরি করা হয়। দুই দশকের বেশি সময় ধরে পরীক্ষাগারে স্টেম সেল থেকে বিভিন্ন অঙ্গ তৈরিতে কাজ করছেন গবেষকেরা।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষকেরা বলছেন, মস্তিষ্কের অর্গানয়েডের সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্কের মিল খুবই কম। তবে কৃত্রিমভাবে তৈরি এই মস্তিষ্কের আকার খুবই ছোট।
তবে কলমের বিন্দুর সমান এই কোষে যে নিউরন থাকে, তা মানুষের মস্তিষ্কের মতোই কাজ করতে পারে। এই নিউরন বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম। কৃত্রিম মস্তিষ্কের এই কার্যক্রমকে গবেষকেরা বলছেন, ‘একটি পাত্রে সৃষ্ট বুদ্ধিমত্তা’।
জনস হপকিনস ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের পরিবেশগত স্বাস্থ্য ও প্রকৌশলের অধ্যাপক থমাস হারতং ২০১২ সাল থেকে মানুষের ত্বকের কোষ ব্যবহার করে মস্তিষ্কের অর্গানয়েডস তৈরির কাজ শুরু করেন।
সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে মস্তিষ্কের অর্গানয়েডস থেকে একধরনের জৈবিক হার্ডওয়্যার তৈরির পরিকল্পনা করেন তিনি। তাঁদের ধারণা, এই নেটওয়ার্ক আরও বেশি শক্তিসাশ্রয়ী ও সুপারকম্পিউটারের চেয়ে শক্তিশালী হবে।
একে তারা তাই ‘বায়োকম্পিউটার’ বা জৈব কম্পিউটার নাম দেন। এই কম্পিউটার মস্তিষ্কের অর্গানয়েডের যে নেটওয়ার্ক তৈরি করবে, তা ভবিষ্যতে বিভিন্ন ওষুধ পরীক্ষায় বৈপ্লবিক ফল আনবে বলে মনে করেন তারা।
আলঝেইমারের মতো রোগের জন্য ওষুধ পরীক্ষায় একে ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া মানুষের মস্তিষ্কের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য দেবে, যা ভবিষ্যতে কম্পিউটারের ধারণা পরিবর্তন করে দিতে পারে।
গবেষণাসংক্রান্ত নিবন্ধটি গত মঙ্গলবার প্রকাশিত হয়েছে ফ্রন্টায়ার্স ইন সায়েন্স সাময়িকীতে। এ নিবন্ধে গবেষক হারতং লিখেছেন, কম্পিউটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির বিপ্লব তৈরি হয়েছে।
এই প্রযুক্তি এখন অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। জৈব কম্পিউটিংয়ের মাধ্যমে কম্পিউটারের শক্তি আরও বাড়িয়ে দেওয়া এবং বর্তমান প্রযুক্তিগত সীমা অতিক্রম করার এক বিরাট প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
ইন্ডিপেন্ডেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়োকম্পিউটারের ব্যবহারিক ব্যবহারের শুরুর আগে বেশ কিছু কাজ করা জরুরী। এগুলো আকারেও অনেক বড় হতে হবে। বিদ্যমান মস্তিষ্কের অর্গানয়েডে ৫০ হাজার কোষ থাকলেও, অর্গানিক ইন্টেলিজেন্স ব্যবহারের জন্য বিজ্ঞানীদের প্রয়োজন এক কোটি কোষ। সেই সঙ্গে এগুলো কী ভাবছে, তা বুঝতে বিভিন্ন তথ্য প্রেরণ ও গ্রহণের মাধ্যমে এগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।
কম্পিউটিং ব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি অর্গানিক কম্পিউটারের সহায়তায় আমরা সেইসব মস্তিষ্ক সম্পর্কেও জানতে পারব, যা তাদের অনুপ্রাণিত করেছে। গবেষকরা তুলনা করতে পারেন, এইসব স্বাস্থ্যকর অর্গানয়েড কীভাবে এমন লোকজনের কাছে শিখতে পারে, যারা স্নায়বিক দুর্বলতায় ভুগছেন। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, বিভিন্ন পদার্থ কীভাবে মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে, সেটির পরীক্ষা করা।
গবেষকরা বলেন, মানুষের মতোই শেখার ও স্মরণ করার এমনকি বোঝার সক্ষমতা থাকা মস্তিষ্ক তৈরি করলে তা বিভিন্ন নৈতিক চ্যালেঞ্জ বয়ে আনতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক টমাস হারটুং বলেন, “আমাদের লক্ষ্যমাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, নৈতিক ও সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল উপায়ে ওআই তৈরি করা।”
“এই কারণে আমরা ‘এম্বেডেড এথিকস’ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রথম থেকেই নৈতিকতা সমর্থকদের সঙ্গে অংশ নিয়েছি। গবেষণাটি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিজ্ঞানী, নীতিবিদ ও জনসাধারণের সমন্বয়ে গঠিত দলের মাধ্যমে সকল নীতিগত বিষয়গুলোর ক্রমাগত মূল্যায়ন করা হবে।”
নতুন এই কার্যক্রম বর্ণিত হয়েছে ‘অর্গানয়েড ইন্টেলিজেন্স (ওআই): দ্য নিউ ফ্রন্টিয়ার ইন বায়োকম্পিউটিং অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ইন-এ-ডিশ’ শিরোনামের গবেষণা পত্রে। আর এটি প্রকাশ পেয়েছে ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন সায়েন্স’ জার্নালে।
এসডব্লিউএসএস/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ