এলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনউ বেঞ্চ একটি রায়ে কেন্দ্রের কাছে আর্জি জানিয়েছে- গরুকে জাতীয় প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করা হোক। অবিলম্বে গো হত্যা বন্ধে দেশজুড়ে আইন জারি করা হোক।
বিচারপতি শামীম আহমেদ এই রায় জারি করে বলেন, হিন্দু শাস্ত্রে গরুকে পবিত্র প্রাণী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই প্রাণীকে গোটা ভারতে ভগবতী জ্ঞানে পুজো করা হয়। এই প্রাণী হত্যা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত।
বিচারপতি শামীম আহমেদ বড়োবাঙ্কির এক ব্যবসায়ীর গরুর মাংস বিক্রি করার মামলার রায় দিচ্ছিলেন। তখন তিনি বলেন, তিনি হিন্দুশাস্ত্র পড়েছেন, গরু নন্দীরূপে শিবের বাহন, ইন্দ্র কামধেনুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ভগবান শ্রী কৃষ্ণ গো পালক ছিলেন, এই অবস্থায় গো হত্যা অন্যায় শুধু নয়, বেআইনি।
কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদনে বিচারপতি আহমেদ বলেন, অবিলম্বে কেন্দ্রীয় আইন প্রবর্তন করা উচিত গো হত্যা বন্ধে।
বিচারপতির এই নির্দেশে দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। কারণ গো মাংস বিক্রি একটি জীবিকা। সেই জীবিকায় হাত পড়লে কী হতে পারে তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত জনতা।
এছাড়া, ভারত বিশ্বের একটি দেশ, যেখানে বর্তমানেও রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। জন্মান্তরবাদ, জাতপাত আর গো-রক্ষার নামে ভারতের রাজনীতিতে মানুষের ওপর চলে নির্যাতন। গরু হত্যা নিয়েই ভারতে সবচেয়ে বেশি দাঙ্গা হয়েছে।
গরুর মাংস রাখা আছে ঘরে এই মিথ্যা সন্দেহে আখলাককে হত্যা করা হয় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে। সেই সময়ে হরিয়ানার মুখমন্ত্রী ঘোষণা করলেন যে, মুসলমানদের ভারতে থাকতে হলে গো-মাংস খাওয়া ছাড়তে হবে। এতে উৎসাহিত হয়ে স্ব-ঘোষিত গো-রক্ষকরা ‘গরু ব্যবসার’ ওপর আক্রমণ চালাল।
পরিবহনে করে গরু এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কারণে বহুজনকে পেটানো ও হত্যা করা হয়। দু’জন মুসলমান মহিলা ট্রেনে মোষের মাংস নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাদের নির্যাতন করে থানায় পোরা হলো। এ আক্রমণ শুধু মুসলমানদের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ থাকল না।
ভারতে শুধু মুসলমানরা নয়, গো-হত্যা বা গরুর সঙ্গে যুক্ত নানা কারণে দলিতরা প্রায় নির্যাতনের শিকার হয়। ২০১৬ সালে কর্নাটকের চিলমাগালুর জেলায় পাঁচ জন দলিতকে বাড়িতে গো-মাংস রাখার অভিযোগে পুলিশের সামনেই পেটানো হয়।
পরে পুলিশ তাদের ‘কর্নাটক গো-হত্যা নিরোধক ও গো-রক্ষা আইন, ১৯৬৪’-র ধারা প্রয়োগ করে গ্রেফতার করে। ২০১৬ সালে ১১ জুলাই গুজরাটের উনা গ্রামে গো-রক্ষকরা চারজন দলিত যুবককে নগ্ন করে লোহার চেন দিয়ে পেটায়। তাদের ‘অপরাধ’, তারা মরা গরুর চামড়া ছাড়িয়েছিল।
ইতিপূর্বে ২০১৪ সালে পাঞ্জাবে গো-রক্ষকরা কিছু দলিতকে গরু পাচারকারী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের মুখে প্রস্রাব করেছিল।
ভারতের রাজনীতিতে গো-রক্ষার নামে গত ২শ’ বছরে নানারকম দাঙ্গা আর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ভারত ভাগের পিছনেও আছে এই গো-রক্ষা আর তার সঙ্গে যুক্ত হিন্দুত্ববাদ। বিশেষ করে বিশ শতকের কংগ্রেসের কয়েকজন বিশিষ্ট নেতা গো-রক্ষা আন্দোলনকে সবচেয়ে প্রাধান্য দেন।
করমচাঁদ গান্ধী, বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়, মদন মোহন মালব্য, রাজেন্দ্র প্রসাদ, পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডন প্রমুখ বড় বড় নেতারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শয়ে শয়ে সভা করে মূলত সাধারণ হিন্দুদের কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। হিন্দু জনসাধারণের কাছে তখন প্রতিশ্রুতি দেন যে স্বরাজ এলে গো-হত্যা বন্ধ করাই হবে স্বদেশী সরকারের কাজ।
গান্ধী বলেছিলেন, গো-হত্যা বন্ধ করা স্বরাজের চাইতেও তার কাছে বেশি দামি। তাঁর মতে, ‘গো-রক্ষা করাই হিন্দুত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। হিন্দুরা যতদিন গো-রক্ষা করবে, ততদিনই হিন্দুত্ববাদ টিকে থাকবে।’
গান্ধীও ভারতে গো-হত্যা বন্ধ করার পক্ষে প্রচুর লেখালেখি করেছেন আর নানারকম উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি ভারতে তাঁর রাজনীতি শুরু করার প্রথমদিন থেকেই গো-রক্ষা বা গো-হত্যা বন্ধের পক্ষে সরব ছিলেন। গান্ধীর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, গো-রক্ষা আর হিন্দুত্ব সমার্থক।
অথচ প্রাচীন ভারতে যে বৈদিকদের ভিতরে গো-হত্যা চালু ছিল সেটা প্রমাণিত সত্য। প্রাচীন ভারতে গো-মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল না। ইতিহাসের আলোকে বিচার করলে দেখা যাবে, প্রথমত গো-হত্যা বন্ধের পেছনে কাজ করেছে জৈন আর বৌদ্ধধর্মের তথাকথিত অহিংস বাণী-পরে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম তা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে সেটাই বৈদিক ধর্মেরও অংশ হয়ে দাঁড়ায়। ভারতে বৈদিক পূজা অর্চনার সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত ছিল পশু হত্যা।
এসডব্লিউএসএস/২১১৫
আপনার মতামত জানানঃ