২০১৫ সালে বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের অনুমান অনুযায়ী, পৃথিবীতে গাছের সংখ্যা ৩ লাখ কোটিরও বেশি। শুধু আমাজন রেইনফরেস্টেই প্রায় ১৬ হাজার প্রজাতির ৩৯ হাজার কোটি গাছ আছে!
অন্যদিকে, মহাবিশ্বে রয়েছে কোটি কোটি গ্যালাক্সি। ধারণা করা হয়, ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার কোটি গ্যালাক্সি রয়েছে মহাবিশ্বে। প্রতিটি গ্যালাক্সিতে রয়েছে সূর্যের মতো কোটি কোটি তারকা বা নক্ষত্র।
নাসার বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গাতেই আনুমানিক ১০ হাজার কোটি থেকে ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্র আছে।
গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ হচ্ছে একটি বৃহৎ সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা, যা নক্ষত্র, আন্তনাক্ষত্রিক গ্যাস ও ধূলিকণা, প্লাজমা (পদার্থের চতুর্থ অবস্থা) এবং প্রচুর পরিমাণে অদৃশ্য বস্তু দ্বারা গঠিত। মহাবিশ্বের একটি ক্ষুদ্র অংশ হচ্ছে গ্যালাক্সি!
খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪ থেকে ৩২২ যখন অ্যারিস্টটল তার মেটেরোলজিকা-তে আনাক্সাগোরাস আর ডেমোক্রিটাস নামে দুটি গ্রিক ফিলোসফার সম্পর্কে বলেন। তিনিই সর্বপ্রথম আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি গ্যালাক্সির খোঁজ করেন। এই দুই গ্রিক ফিলোসফার অনুসারে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি দূরে অবস্থিত অসংখ্য তারার এক সমষ্টি। কিন্তু অ্যারিস্টটলের এই দাবির অনেক পরে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিলিও গ্যালিলি গ্যালাক্সি সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে সক্ষম হন।
তিনি নিজের টেলিস্কোপ এর সাহায্যে এই সমস্যার সমাধান করেন। তিনি বলেন মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি একটি থালার মতো দেখতে যেটি লক্ষ্য কোটি একক নক্ষত্র নিয়ে গঠিত। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মধ্যে যে নক্ষত্রটি সবথেকে পুরানো অনুমান করা হয় তার বয়স ১৩.৭ গিগাইয়ার মানে কিছু এই রকম ১৩৭০০০০০০০০ কোটি।
অনুমান করা হয় এই গ্যালাক্সি বিগ ব্যাং-এর দ্বারা গঠিত হয়েছিল। আর আমাদের সূর্য এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ছোট্ট একটি নক্ষত্র যাকে পরিক্রমণ করছে আমাদের পৃথিবী ।
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ত্রিমাত্রিক ম্যাপ তৈরি করার জন্য ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা(ইসার) ২০১৪ সালে ৯ ই জানুয়ারি উৎক্ষেপণ করে ”গায়া” টেলিস্কোপসহ একটি রকেট। এটির অবস্থান করছে পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কি.মি। এই টেলিস্কোপটির সাথে সেট করে দেওয়া হয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ক্যামেরা। যার ক্ষমতা ১০০ কোটি পিক্সেল!
এই টেলিস্কোপটির তৈরি করার মূল উদ্দেশ্যে হচ্ছে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ত্রিমাত্রিক (3D) ম্যাপ তৈরি করা। এজন্য এই টেলিস্কোপটির নকশা করা হয় যেন খুব সহজে এটি মহাকাশে ছবি তুলতে পারে।
একই সাথে এটি গ্রহ, ধুমকেতু, গ্রহাণুর একটি ত্রিমাত্রিক তালিকা তৈরি করবে। এছাড়াও এটি বৃহস্পতি আকৃতির ১০ হাজার বহিগ্রহ, ৫ লক্ষ কোয়াসার এবং সৌরজগতের ১০ হাজার গ্রহাণু শনাক্ত করতে সক্ষম হবে বলে প্রত্যাশা করেছেন ইসার মহাকাশ বিজ্ঞানীরা।
এই অভিযানটির প্রধান বিজ্ঞানী মার্ক ম্যাককফরেন বলেছেন, “এই অভিযানটি দিয়ে আমরা সহজেই গ্যালাক্সির রহস্য উদঘাটন করতে পারবো। এর মাধ্যমে ১০০ কোটি নক্ষত্রের অবস্থান নির্ভুলভাবে ম্যাপ আকারে তৈরি করা যাবে। শুধু তাই নয়, তারা কিভাবে ঘুরছে বা কি গতিতে ঘুরছে,তাও জানা যাবে। এর মধ্যে দিয়ে আমররা গ্যালাক্সির ডকুমেন্টরি তৈরি করে ফেলতে পারব।
ভবিষ্যতে কি হবে তা জানার জন্য ত্রিমাত্রিক ম্যাপটিকে আমরা সামনের দিকে চালাতে পারব। যেহেতু এই তারাগুলো কিভাবে চলছে তা আমাদের জানা হয়ে যাবে। সুতরাং, এটাকে আমরা আবার পেছনে দিকেও চালাতে পারবো। ফলে দেখতে পারবো যে কিভাবে এই ছায়াপথের জন্ম হলো।”
তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ডকুমেন্টরি তৈরির মাধ্যমে যদি তারাদের ভবিষ্যৎ অবস্থান সনাক্ত করা যায়, তাহলে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে কীভাবে ছায়াপথের জন্ম হলো, তা জানার আমাদের পক্ষে খুবই সহজ হয়ে যাবে।
এরপর ইসার এই অভিযানের মাধ্যমে ইসার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল ১.৭ বিলিয়ন নক্ষত্রসহ একটি নিখুঁত ছবি। যা আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিটির এখন পর্যন্ত তোলা সবচেয়ে নিখুঁত ছবি। এই ছবি সবাইকে বিস্ময় করে দেয়।
আমাদের পৃথিবী এবং আমরা এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মধ্যেই অবস্থান করছি। আপনাদের মনে হতে পারে যে বারবার মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি কে কেন আমাদের গ্যালাক্সি বলা হচ্ছে। ১৯২০ সাল পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি পুরো ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে একটি গ্যালাক্সি যেখানে সমস্ত নক্ষত্র অবস্থান করছে। কিন্তু ১৯২০ সালের পর এডুইন হাবল বলেন যে এই পুরো ব্রহ্মাণ্ডে একটি গ্যালাক্সি নয় বরং লক্ষ-কোটি গ্যালাক্সির অস্তিত্ব আছে।
আর এইসব গ্যালাক্সির মধ্যেই একটি হল আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। অনুমান করা হয় মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ডায়ামিটার প্রায় এক লক্ষ থেকে এক লক্ষ আশি হাজার লাইট ইয়ার। এই গ্যালাক্সি এতটাই বড় যেখানে রয়েছে ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্রের অস্তিত্ব। এছাড়া ১০০ মিলিয়নের থেকে বেশি প্ল্যানেট মিল্কিওয়েতে থাকতে পারে।
আমাদের সৌরমন্ডল এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির গ্যালাক্টিক সেন্টার থেকে ২৬০০০ লাইট ইয়ার দূরে অবস্থিত আর গ্যালাক্টিক সেন্টারের সাপেক্ষে গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে প্রতি ঘন্টায় ৫ লাখ ১৪ হাজার মাইল স্পীডে ঘুরতে থাকে। এত দ্রুত স্পিডে পরিক্রমণ করার শর্তেও আমাদের সৌরমন্ডল মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে একবার ঘুরে আসতে ২৩০ মিলিয়ন বছর সময় নিয়ে নেয়। আমরা রাতের আকাশে খালি চোখে যত নক্ষত্র দেখতে পাই তাদের মধ্যে বেশিরভাগ নক্ষত্রই আমাদের এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্তর্গত। যার মাত্র ০.০০০০০২৫ শতাংশই আমরা দেখতে পাই। এইসব বড় বড় নক্ষত্রের সাথে গ্যাস, ধুলো এছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন পদার্থ মিলেমিশে একটি গ্রাভিটেশান পুলের দ্বারা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি তৈরি হয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/০৯৩৫
আপনার মতামত জানানঃ