একটা প্রশ্ন বেশ জোরেশোরেই হয়েছিল যে ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ নিতে বাংলাদেশকে কি মোদি সরকার চাপ প্রয়োগ করেছে! অঢেল সম্পদের চূড়া থেকে যখন দ্রুত গতিতে নিচে গড়িয়ে পড়ছে গৌতম আদানি তখন এই প্রশ্নটা উত্তর হয়ে ফিরে আসলো।
এখানে বলে রাখি, আদানি গ্রুপের দুটি ইউনিটে ১৫০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আগামী ২৫ বছর মেয়াদে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ১ লাখ ৮ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা বা ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ নেবে। এ দিয়ে কমপক্ষে তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।
প্রসঙ্গত, ভারতের পাঁচটি উৎস থেকে বর্তমানে বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। যদিও চাহিদা না থাকায় আমদানি সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না। এরপরও ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে আমদানি করা হবে আরও এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদানির এ বিদ্যুৎ আমদানির কোনো প্রয়োজনই ছিল না। কারণ বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। আর চাহিদা ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। তবে শীতে এ চাহিদা সাত থেকে আট হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসে। আবার সন্ধ্যার তুলনায় দিনে চাহিদা অনেকখানি কমে যায়।
তাই উচ্চ ব্যয়ে আদানির বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত পুরোই অযৌক্তিক। এছাড়া এ বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়ও অনেক বেশি পড়বে বলে আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে।
এবার আসি সাম্প্রতিক প্রসঙ্গে। ভারতের স্টক এক্সচেঞ্জে এক আবেদন অনুযায়ী, গৌতম আদানির মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কোম্পানি থেকে হ্রাসকৃত মূল্যে বিদ্যুৎ চাইছেন বাংলাদেশি কর্মকর্তা। বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে মঙ্গলবার।
এর মধ্য দিয়ে ভারতের বিলিয়নিয়ার গৌতম আদানির বিপুল পরিমাণ ‘স্ক্রুটিনি’র লক্ষণ বেরিয়ে এলো। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক খবরে এ কথা লিখেছেন সাংবাদিক গেরি শিহ এবং অনন্ত গুপ্ত।
এতে বলা হয়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অব ইন্ডিয়ার কাছে এ বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে ৩রা ফেব্রুয়ারি। তা মঙ্গলবার প্রকাশ করেছে স্টক এক্সচেঞ্জ। এতে আদানি পাওয়ার ভারতের নিয়ন্ত্রকদের বলেছে যে, লোভনীয় বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে ডিসকাউন্ট বিবেচনা করতে আমাদের কাছে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ।
২০১৭ সালে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। কিন্তু তা বছরের পর বছর রয়েছে গোপনীয়তায় আবৃত। এই পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট (পিপিএ) চুক্তি ১৬৩ পৃষ্ঠার। গোপন এই চুক্তি ডিসেম্বরে হাতে পেয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট এবং তারা এ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
এই গোপন চুক্তির অধীনে দরিদ্র ও ঋণের ভারে জর্জরিত বাংলাদেশ আদানি প্রতিষ্ঠিত কয়লাচালিত নতুন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুতের উচ্চ মূল্য পরিশোধ করবে। গৌতম আদানি হলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দীর্ঘদিনের মিত্র। তাদের কাছ থেকে যে মূল্যে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে তা অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি।
উপরন্তু ক্রয়চুক্তিতে যেসব শর্ত রয়েছে তা অস্বাভাবিক। এর মধ্যে আছে কয়লার মূল্য বেঁধে না দেয়া। এর অর্থ হলো বাংলাদেশ উচ্চ মূল্য চার্জ করতে পারেন আদানি। তিনি নিজস্ব শিপিং নেটওয়ার্ক এবং কয়লা হ্যান্ডেলিং বিষয়ক পোর্টের মাধ্যমে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করবেন বলেই মনে হচ্ছে।
২০১৫ সালে রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এরপর আদানি এবং বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট (পিপিএ)। সফরে ভারতীয় নেতৃত্ব বাংলাদেশ সরকারের কাছে বাংলাদেশে ভারতীয় ব্যবসাকে প্রবেশের সুযোগ দেয়ার অনুরোধ করেন।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আদানির সঙ্গে এই চুক্তি নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশি কর্মকর্তারা। স্থানীয় মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, তারা এর শর্ত নিয়ে নতুন করে সমঝোতা প্রত্যাশা করেন। কিন্তু এ সপ্তাহে ভারতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোতে লেখা চিঠিতে আদানি পাওয়ার বলেছে, বিদ্যুৎ কেনা বিষয়ে এই চুক্তি নতুন করে আলোচনা করা হচ্ছে না।
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন আদানির মুখপাত্র বর্ষা চাইনানি। এমনকি অনুরোধ করলেও এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
ওদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আদানির সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে উল্কাগতিতে। ভারত সহ আন্তর্জাতিক ব্যবসা সার্কেলে তিনি সবার নজরে এসেছেন। কিন্তু কয়েক সপ্তাহে তার সাতটি কোম্পানি পাবলিক ট্রেড করে মারাত্মক লোকসান খেয়েছে। বাজারে হারিয়েছে কমপক্ষে ১০০০০ কোটি ডলার।
এটা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হিন্ডেনবার্গ রিসার্স প্রকাশিত ২৪শে জানুয়ারির এক রিপোর্টের পর। এতে তার ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ করা হয়েছে। তবে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন আদানির শীর্ষ নির্বাহীরা। তারা বলেছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সমালোচনা ভারতের ওপরও আঘাত হেনেছে।
গত বছর ওয়াশিংটন পোস্ট একটি তদন্ত করে। তাতে দেখা যায়, আদানি পাওয়ার বিষয়ক প্রকল্প ব্যাপকভাবে আয়কর নীতি ভঙ্গ করেছে। আইন পরিবর্তন করা হয়েছে মোদি সরকারের অধীনে। এর ফলে এই বিলিয়নিয়ারের প্রতিষ্ঠান কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলার সেভ করতে সক্ষম হয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/১১৫৯
আপনার মতামত জানানঃ