চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা টি-১০০০ এর মতোই কিন্তু খুব ছোট আকৃতির রোবট তৈরি করেছেন। এই রোবট এমন ধাতুতে তৈরি যা রুম টেম্পারেচারেই গলতে পারে। ফলে উদ্ভাবকরা নিজেদের ইচ্ছেমতো এটি কখন শক্ত থাকবে বা কখন গলে রূপ বদল করবে; সেটা নির্ধারণ করতে পারেন।
হলিউডের বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন- টার্মিনেটর ২: জাজমেন্ট ডে’ চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়ে কী! যেখানে নায়ক আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের মিশন ছিল- সারা ও জন কনরকে টি-১০০০ নামক খুনি রোবটের হাত থেকে বাঁচানো, যে রোবট ইচ্ছেমতো আকার ধারণ করতে পারত। গুলিতে ছিদ্র হলেও তা জুড়ে যেত সাথে সাথে। খবর এল পাইসের।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা টি-১০০০ এর মতোনই কিন্তু খুব ছোট আকৃতির রোবট তৈরি করেছেন। এই রোবট এমন ধাতুতে তৈরি যা রুম টেম্পারেচারেই গলতে পারে। ফলে উদ্ভাবকরা নিজেদের ইচ্ছেমতো এটি কখন শক্ত থাকবে বা কখন গলে রূপ বদল করবে; সেটা নির্ধারণ করতে পারেন।
এভাবে লোহার গরদ থেকেও বেড়িয়ে এসেছে রোবটটি। অর্থাৎ, শিকের কাছে এসে নিজের শরীর গলিয়েছে এবং তারপর শিক পার করে আবার শক্ত রূপ নিয়েছে। শুধু তাই নয়, মানুষের পাকস্থলী থেকেও অনাহূত বস্তু অপসারণ করেছে এই রোবট। জুড়েছে এলইডি সার্কিট।
জেমস ক্যামেরুনের বিখ্যাত চলচ্চিত্রের গল্পে টি-১০০০ এর প্রস্তুতকারক ছিল স্কাইনেট নামক এক অশুভ কোম্পানি। মিমেটিক পলিঅ্যালয়’ নামক কাল্পনিক তরল ধাতুতে নির্মিত হয় এটি।
কিন্তু, বাস্তব দুনিয়ার রোবটটিকে তৈরি করা হয়েছে গ্যালিয়াম নামক এক ধরনের ধাতব ম্যাট্রিক্স দিয়ে। সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ অবস্থায় এই ধাতু মাত্র ২৯.৮ ডিগ্রী সেলসিয়াল তাপমাত্রায় গলতে পারে। অর্থাৎ, হাতের মুঠোয় রাখলেই সে উষ্ণতায় এটি গলে যেতে পারবে।
তবে শুধু গ্যালিয়াম দিয়েই রোবটটি তৈরি করা হয়নি। তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রতি এটি যেন আরও ভালোভাবে সাড়া দেয়; সেজন্য এতে যুক্ত করা হয়েছে নিওডাইমিয়াম, লৌহ ও বোরন ধাতু। চলতি সপ্তাহে বৈজ্ঞানিক জার্নাল- মেটার- এ প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে এসব তথ্য জানানো হয়।
নিওডাইমিয়াম, লৌহ, বোরন ও গ্যালিয়াম দিয়ে তৈরি যে সংকর ধাতু এটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে তার নাম– ম্যাগনোঅ্যাকটিভ ফেইজ ট্রানজিশনাল ম্যাটার বা সংক্ষেপে এমপিটিএম।
এটি যেভাবে কাজ করে তা হলো- তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র প্রথমে নির্দিষ্ট মাত্রায় বিদ্যুৎ তরঙ্গ সঞ্চালন করে, এতে তাপ উৎপন্ন হয়। আর তাতেই শক্ত আকার থেকে গলে নমনীয় রূপ দেয় রোবট। তড়িৎচুম্বকীয় এই ক্ষেত্রের মাধ্যমে নিজ উচ্চতার চেয়েও ২০ গুণ বেশি উচ্চতায় লাফ দিতে পারে এটি।
প্রতিমিনিটে দেড় হাজার বার ঘুরতে পারে। আর চলতে পারে প্রতিসেকেন্ডে এক মিটারের মতো দ্রুত গতিতে। তবে কাল্পনিক টি-১০০০ এর মতো বড় নয় এটি। উচ্চতায় মাত্র প্রায় এক সেন্টিমিটার। কিন্তু, ছোট্ট হলেও শক্তি ও সক্ষমতায় ভরপুর।
আবিষ্কারক বিজ্ঞানীরা এর একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন। সেখানে লেগো দিয়ে তৈরি মিনিফিগার আকারে দেখা যায় রোবটটিকে। এই আকারেই সেটিকে লোহার গারদ থেকে গলে বাইরে বেড়িয়ে যেতে দেখা যায়। বাইরে গিয়ে আবার এটি শক্ত রুপে ফিরে আসে।
কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক কার্মেল মাজিদি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘চুম্বকীয় ক্ষেত্র দিয়ে এটিকে গলিয়ে, বদ্ধ জায়গা থেকে বাইরে আনা হয়’। ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পৌঁছালেই গলতে পারে গ্যালিয়াম, তার নিচের তাপাঙ্কে এটি আবার শক্ত রূপ নিতে পারে। তবে হাতের তালুর তাপমাত্রায় গলতে পারার মানে এই নয় যে এটি অন্য ধাতুর মতো শক্ত হতে পারবে না।
বিজ্ঞানীরা তাদের এই আবিষ্কারকে নানানভাবে পরীক্ষা করেছেন। যেমন একটি পরীক্ষায় এটিকে এমন স্ক্রুতে পরিণত করা হয়, যা বিভিন্ন কোণায় পৌঁছাতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথমে গলে ওই কোণায় যায় রোবট, তারপর ছিদ্রে ঢুকে আবার শক্ত রূপ নেয়। আরেকটি পরীক্ষায় এমপিটিএম রোবট এলইডি সার্কিট ঝালাইকারীর কাজ করেছে। গ্যালিয়াম সার্কিটের সোলডার ও বিদ্যুৎবাহী ধাতু হিসেবে কাজ করতে পারে। ফলে সার্কিট জোড়া দেওয়ার কাজেও এর ব্যবহার করা যাবে।
এক্ষেত্রে অবশ্য একটি সমস্যা আছে। এই ধাতু যেহেতু রুম টেম্পারেচারেই গলে যায়, সেক্ষেত্রে সার্কিট উষ্ণতর হয়ে উঠলে তখনও কী কার্যকর হবে?
মাজিদি বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, নিম্ন গলনাঙ্কের কারণে সার্কিটের তাপমাত্রা বাড়লে গ্যালিয়াম নরম হতে পারে, বা গলেও যেতে পারে। তবে গলন্ত অবস্থাতেও এর বিদ্যুৎ পরিবাহীতা থাকবে। ফলে পারদর্শীতায় কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে গলে গিয়ে যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য এটিকে রাবার বা অন্য কোনো ইনসুলেশন আবরণ দিয়ে মুড়ে দিতে হবে।
কার্নেগী মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের সফট মেকানিক্স ল্যাবের পরিচালক হলেন মাজিদি। তিনি নমনীয় ধাতু বিশারদ। তিনি এমপিটিএম রোবটের গলে যাওয়ার দিকটি নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন নন।
কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, আমার বেশিরভাগ গবেষণায় তরল ধাতুতে নির্মিত সার্কিটের ওপর। আমরা চেষ্টা করি, যাতে তরল অবস্থাতেও ধাতুর পরিবাহী বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে। সঠিকভাবে সিল ও ইনসুলেট করা হলে এসব ধাতু গলে ছড়িয়ে পড়ার ভাবনা থাকে না।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে এমপিটিএম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে মনে করেন এর আবিষ্কারকরা। পানিভর্তি মানুষের পাকস্থলীর একটি মডেলে তারা এটি দিয়ে পরীক্ষা চালান।
পাকস্থলীতে অনাহূত কোনো বস্তু ঢুকে পড়া এবং সেখানে ওষুধ প্রয়োগ করা চিকিৎসা শাস্ত্রের জন্য দুটি বড় সমস্যা। প্রথম পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা রোবটটির সাহায্যে পাকস্থলী থেকে অনাহূত বস্তু সরিয়ে ফেলতে সফল হন।
রোবটটি পাকস্থলীতে প্রবেশ করে, ওই বস্তুর কাছে গিয়ে প্রথমে নিজেকে গলিয়ে ফেলে এর চারপাশে আবরণের মতো জড়িয়ে পড়ে। এরপর আবার শক্ত আকার নেয়। বিজ্ঞানীরা তখন চুম্বকের মাধ্যমে ধাতব রোবটসহ ওই বস্তুটিকে বের করে আনেন।
অন্য একটি পরীক্ষায় ওষুধকে এমপিটিএম রোবট দিয়ে মুড়িয়ে ফেলেন বিজ্ঞানীরা, এরপর পাকস্থলীর কাঙ্ক্ষিত স্থানে গিয়ে রোবটটি গলে যায় আর ওষুধটিকে মুক্ত করে দেয়।
গবেষণা নিবন্ধের সহ-লেখক ও চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের প্রকৌশলী চেংফেং প্যান বলেন, রোবটকে তরল ও শক্ত উভয় ধরনের আকার নেওয়ার সক্ষমতা দেওয়ার মাধ্যমে এর ব্যবহার উপযোগীতা বেড়েছে। এর সহায়তায় ভবিষ্যতে বিভিন্ন ধরনের প্রকৌশল ও চিকিৎসা সমস্যার সমাধান করা যাবে।
সূত্র: টিবিএস
আপনার মতামত জানানঃ