সুইডেনে পবিত্র কুরআন পোড়ানো এবং তুরস্কভিত্তিক পিকেকে সন্ত্রাসীদের সমর্থন দেওয়া কেন্দ্র করে যাবতীয় আলোচনা বাতিল করেছে আঙ্কারা।
প্রসঙ্গত, গত বছরের আগস্টে শুরু হয়েছিল তিন দেশের এ আলোচনা। খবরে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তুরস্ক ও সুইডেনের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। কারণ আঙ্কারা ঘোষিত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন পিকেকের সমর্থকদের তুর্কিবিরোধী সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া এবং সম্প্রতি স্টকহোমে তুর্কি দূতাবাসের সামনে কুরআনের একটি অনুলিপি পোড়ানোর ঘটনায় সুইডেনের তীব্র সমালোচনা করেছে তুরস্ক।
গত শনিবার উগ্র ডানপন্থি রাজনীতিক রাসমুস পালুদান কুরআনের একটি কপিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সুইডেন সরকারের অনুমতি নিয়ে এবং দেশটির পুলিশের নিরাপত্তাবলয়ে থেকেই এ ন্যক্কারজনক কাজটি করে সে।
এ ছাড়া চলতি জানুয়ারি মাসেই স্টকহোমে সন্ত্রাসীদের সমর্থকদের একটি সমাবেশের অনুমতি দেয় সুইডিশ সরকার। যেখানে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের একটি কুশপুত্তলিকা ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়।
অথচ মাদ্রিদে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) শর্তানুসারে তুরস্কের উদ্বেগ দূর করতে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সুইডেনের।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আবেদন করে দুই নরডিক রাষ্ট্র সুইডেন ও ফিনল্যান্ড। কিন্তু সামরিক জোট ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম সদস্য তুরস্কের অনুমোদন ছাড়া সদস্যপদ লাভ করতে পারবে না দেশ দুটি।
তুরস্কের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হচ্ছিল যে, সমঝোতা স্মারকের শর্ত অনুযায়ী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না সুইডেন। তার মধ্যেই সম্প্রতি তুর্কির নেতার প্রতীকী ফাঁসি কার্যকর বরং কুরআন পোড়ানোর ঘটনা ঘটল।
এতে স্টকহোমের সঙ্গে আঙ্কারার উত্তেজনা আরও বেড়ে যাওয়ার পেক্ষাপটে আলোচনা বাতিল করল তুরস্ক। এদিকে তুরস্ক আলোচনা বাতিল করার পর সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উল্ফ ক্রিস্টারসন নতুন করে আঙ্কারার সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন।
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমাদের সম্মিলিত বার্তা হলো, আমরা শান্তির পথে অগ্রসর হতে চাই। আমরা শান্তিকে উৎসাহিত করতে চাই। যাতে আমাদের ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে আলোচনা এগিয়ে নিতে পারি।
কেন পোড়ানো হল কুরআন?
মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে সুইডেনের সদস্যপদ পাওয়া নিয়ে তুরস্কের আপত্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে দেশটির উগ্র ডানপন্থীরা। আর এই বিক্ষোভে ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে তুরস্কের দূতাবাসের সামনে সুইডেনের কট্টরপন্থিরা এই ঘটনা ঘটায়।
এই ঘটনায় নিন্দা জানানোর পাশাপাশি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে তুরস্ক। গত শনিবার (২১ জানুয়ারি) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্টকহোমে তুর্কি দূতাবাসের সামনে সুইডেনের উগ্র ডানপন্থিদের বিক্ষোভে কোরআন পোড়ানোসহ কুর্দিদের পৃথক বিক্ষোভের ঘটনায় সুইডেনের নিন্দা জানিয়েছে তুরস্ক। শনিবার আঙ্কারা জানিয়েছে, তারা সুইডেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর একটি সফর বাতিল করে দিয়েছে।
মূলত মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোতে সুইডেনের সদস্যপদ পাওয়া নিয়ে তুরস্কের আপত্তি কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে সুইডিশ ওই প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আঙ্কারা সফরে যাওয়ার কথা ছিল। কারণ ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর ইউরোপে রুশ আতঙ্ক বেড়ে যাওয়ায় সামরিক এই জোটটিতে প্রবেশের জন্য তুরস্কের সমর্থন প্রয়োজন সুইডেনের।
আল জাজিরা বলছে, রাজধানী স্টকহামে শনিবার উগ্রপন্থি সুইডিশ রাজনীতিবিদ রাসমুস পালুদানকে তুরস্কের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করার অনুমতি দেয় সুইডেন। আর সেখানেই বিক্ষোভের নামে পবিত্র কোরআন পোড়ানোর কাজটি পরিচালনা করেন উগ্র ডানপন্থি রাজনৈতিক দল হার্ড লাইনের নেতা রাসমুস পালুদান।
এর আগে গত বছরের এপ্রিলে মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাসে পালুদানের কোরআন পোড়ানোর ঘোষণা সুইডেনজুড়ে দাঙ্গার জন্ম দিয়েছিল।
শনিবার পুলিশ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পালুদান একটি লাইটার দিয়ে পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআনে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সেখানে তিনি সুইডেনে ইসলাম এবং অভিবাসনকে আক্রমণ ও সমালোচনা করেন। তবে এই ঘটনায় শান্তিপূর্ণভাবে পাল্টা বিক্ষোভের জন্য প্রায় ১০০ জন লোক কাছাকাছি স্থানে জড়ো হয়েছিলেন।
সেখানে তিনি বলেন, ‘আপনি যদি মনে করেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত নয়, তবে আপনাকে অন্য কোথাও থাকতে হবে।’
বিভিন্ন দেশের নিন্দা
এই ঘটনায় বিবৃতি দিয়ে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানায়। মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘আমরা আমাদের পবিত্র গ্রন্থের ওপর জঘন্য হামলার সম্ভাব্য সবচেয়ে জোরালো ভাষায় নিন্দা জানাই… মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে এই ইসলাম বিরোধী কাজের অনুমতি দেওয়া সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য। মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করে পরিচালিত এই কাজ আমাদের পবিত্র মূল্যবোধের অবমাননা করে।’
সৌদি আরব, জর্ডান এবং কুয়েতসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশও পবিত্র কোরআন পোড়ানোর নিন্দা জানিয়েছে। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, সৌদি আরব সংলাপ, সহনশীলতা এবং সহাবস্থানের মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে এবং ঘৃণা ও চরমপন্থাকে প্রত্যাখ্যান করছে।
মূলত গত বছরের জুনে সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দিতে তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি করে ফিনল্যান্ড-সুইডেন। ওই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, কুর্দি সন্ত্রাসীদের কোনও প্রশয় দিতে পারবে না এই দুটি দেশ। একইসঙ্গে ফিনল্যান্ড-সুইডেনে বসবাসরত পলাতক কুর্দি সন্ত্রাসীদের তুরস্কের হাতে তুলে দিতে হবে। তবে সুইডেন সেসব শর্ত ভঙ্গ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সামরিক জোট ন্যাটোতে তুরস্ক যোগ দেয় ১৯৫২ সালে। নিয়ম অনুযায়ী, মার্কিন নেতৃত্বাধীন এই জোটে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের সম্মতির প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে এই জোটে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ রয়েছে তুরস্কের।
এসডব্লিউএসএস/২১২৫
আপনার মতামত জানানঃ