ভ্যাট ও ট্যাক্সের হার বৃদ্ধি, বাস্তবায়নকাল বেড়ে যাওয়া এবং ডলার ও নির্মাণ উপকরণের বাড়তি মূল্যের কারণ দেখিয়ে শেষে এসে ২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে পদ্মা সেতুর জন্য। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ প্রস্তাবটি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। আগামী সপ্তাহে তা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর কথা রয়েছে।
প্রস্তাবটি অনুমোদন হলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ৩২ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলত নদীশাসনের কাজ পিছিয়ে থাকার কারণেই মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
গত বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরদিন শুরু হয় যানবাহন চলাচল। সেতু চালু হলেও পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত। নদীশাসনসহ আনুষঙ্গিক কিছু কাজ এখনো চলছে।
নদীশাসন কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৯৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। মূল সেতুর অগ্রগতি ৯৯ দশমিক ৭ শতাংশ। আর পুরো প্রকল্পের নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৯৫ দশমিক ৮ শতাংশ। বিপরীতে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৯৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
ব্যয় বৃদ্ধির জন্য বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এর প্রথমটি হলো ভ্যাট ও ট্যাক্স বৃদ্ধি। নিয়ম অনুযায়ী, ভ্যাট ও ট্যাক্স দেবে ঠিকাদার। বিদেশী ঠিকাদারের জন্য আগে ভ্যাট ও ট্যাক্সের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ১৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, অতিরিক্ত সাড়ে ৪ শতাংশ ভ্যাট ও ট্যাক্স ঠিকাদারের বদলে প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করতে হবে।
ফলে এ খাতে অতিরিক্ত ৬৮৭ কোটি টাকা প্রয়োজন হচ্ছে। এর মধ্যে মূল সেতুর জন্য অতিরিক্ত ভ্যাট ও ট্যাক্স লাগছে ৪০৫ কোটি টাকা। নদীশাসন কাজের জন্য লাগছে আরো ২৮২ কোটি টাকা।
মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে অতিরিক্ত ৪৩ মাস সময় লাগছে। নদীশাসন কাজের জন্য অতিরিক্ত সময় লাগছে ৫৫ মাস। অতিরিক্ত কাজের জন্য প্রকল্পের পরামর্শক খাতে (কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট) ৯৫৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালুর পর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণকাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি কিনতে হচ্ছে। অপটিক ফাইবার কেবল স্থাপন করা হচ্ছে। টোল প্লাজা এলাকায় কিছু বাড়তি কাজ করতে হচ্ছে। বাস-বে ও ট্রাকের জন্য বিশেষায়িত লেন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
আনসার ব্যারাক, জাদুঘরসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে, যেগুলোর কারণে ব্যয় বাড়ছে। এর বাইরে পদ্মা সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও মোটা অংকের টাকা খরচ হয়েছে, যা নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। পদ্মা সেতুর ২২টি পিয়ারের নকশা সংশোধন এবং সাতটি ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন টাওয়ার নির্মাণ বাবদও প্রকল্পের খরচ বেড়েছে।
পদ্মা সেতুর নদীশাসন কাজে ব্যবহূত হচ্ছে ৮০০ কেজি ধারণক্ষমতার জিও ব্যাগ। শুরুতে প্রতিটি জিও ব্যাগের দাম ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৬১৭ টাকা। পরবর্তী সময়ে প্রতিটি জিও ব্যাগের দাম হয়েছে ২ হাজার ৫৯ টাকা। জিও ব্যাগের মূল্যবৃদ্ধি সার্বিক নির্মাণ ব্যয়ে প্রভাব ফেলেছে। এসবের বাইরে ডলার এবং বিভিন্ন ধরনের নির্মাণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণেও বাড়তে যাচ্ছে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাবটি বর্তমানে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা। আগামী সপ্তাহে প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর কথা রয়েছে।
প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। এটি বাড়িয়ে ১৩ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকায় উন্নীতের প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে নদীশাসন কাজের জন্য ৯ হাজার ৪০০ কোটি থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পরামর্শক খাতের ব্যয় ৭৮৮ কোটি থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকায় উন্নীতের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
শেষ মুহূর্তে এসে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা যখন প্রকল্পের কাজ শুরু করি, তখন ১ ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী মুদ্রার মূল্যমান ছিল ৭৮ দশমিক ৩ টাকা। এখন তো ডলারের দাম অনেক বেশি। প্রকল্পের কাজের জন্য যেহেতু আমাদের ডলার কিনতে হয়, সেহেতু এখন বাড়তি দাম পরিশোধ করতে হচ্ছে।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অন্তত ৬০০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন অনুষঙ্গেও ৪০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় বেড়েছে। এর বাইরে কিছু ইকুইপমেন্ট কিনতে হয়েছে এবং এখনো কেনা হচ্ছে। এখানে ২৫০-৩০০ কোটি টাকার মতো লাগছে।
ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ও মোটামুটি প্রস্তাবটিতে একমত পোষণ করেছে। তারা এখন পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাবে। সেখানে কিছু কম-বেশি হতে পারে।’
এক বছরের ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডসহ পদ্মা সেতু প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের জুনে। যেহেতু নদীশাসনের কাজ এখনো শেষ হয়নি তাই মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে জানান শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের জুনে নদীশাসন কাজ শেষ হবে। ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডের জন্য আমরা আরো এক বছর সময় চেয়েছি।’
এসডব্লিউএসএ/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ