ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আর মহামারি পরবর্তী সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটার ফল হিসেবে চলতি বছরের প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভুগতে হয়েছে। একদিকে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে ডলার সংকটে আমদানি এবং ব্যাংকিং খাতেও ছিল সংকট।
মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকে তারল্য সংকট, টাকার দরপতনের মতো পরিস্থিতিতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে সুদ হারে পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক ঋণের নয়ছয় সুদ হার ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ব্যাংকের আমানতের ওপর বেঁধে দেয়া সুদ হার তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতের সুদ হার নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারবে।
তবে ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে এ সুদ হার সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আর ভোক্তা ঋণ নিয়ে থাকেন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা। যেমন; ব্যক্তিগত ঋণ, গাড়ি ঋণ, আবাসন ঋণ, শিক্ষা ঋণ প্রভৃতি নিয়ে থাকেন। এদের ওপর খরচের বোঝা বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা জানান, নতুন করে ভোক্তা ঋণের সুদ হার বাড়ায় দেশের মানুষের জীবনযাপনের খরচ আরও বাড়লো। এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান পণ্য চাল, জ্বালানি তেল, চিনি, ভোজ্য তেল ও ডালের দাম বেড়েছে। সার্বিকভাবে মধ্যম ও নিম্নআয়ের মানুষ যখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। এই শ্রেণির মানুষজন এখন ঋণ করে সংসার চালাচ্ছেন।
তখনই ভোক্তা ঋণের সুদ হার বাড়ালো বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সীমিত আয় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভোক্তা ঋণের সুদ হার বৃদ্ধির বিষয়ে অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের ব্যাংকগুলো প্রতি বছর যে পরিমাণ ঋণ দিয়ে থাকে, সেখানে ভোক্তা ঋণের পরিমাণ ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১০ শতাংশের কম। তাই শুধু ভোক্তা ঋণে সুদ বাড়িয়ে ঋণ বিতরণে কতটা গতি আনা যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের মানুষের একটি অংশকে ঋণ করে জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ মেটাতে হচ্ছে। এখন ভোক্তা ঋণের সুদ বাড়ানোর ফলে তারা আরও চাপে পড়বেন। দেখা যাচ্ছে, ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশে ঠিকই ধরে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে সুদ হার ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ১২ শতাংশ বাড়ানোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে সুদ হার ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। বর্তমানে ব্যাংকের সব ধরনের ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশে বেঁধে রাখা হয়েছে। এখন সেখানে ভোক্তা ঋণের সুদ হার বাড়িয়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত করতে পারবে ব্যাংকগুলো। এর আগে ২০২১ সালের আগস্টে আমানতের সর্বনিম্ন সুদ হার বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, তিন মাস ও তার বেশি মেয়াদি আমানতের সুদ কোনোভাবেই তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির কম হতে পারবে না। ২০২০ সালের এপ্রিলে ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়ার পর আমানতের সুদ হার আড়াই শতাংশেও নামিয়ে এনেছিল।
বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতি যেখানে উঠেছে, তাতে ব্যাংকগুলোকে আমানতের সুদ হারও বাড়াতে হয়। কিন্তু ঋণের সুদ নির্দিষ্ট থাকায় ঋণ ও আমানতের সুদের মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। এজন্য ব্যাংকগুলো ঋণ ও আমানতের সুদ হার তুলে নেয়ার দাবি করে আসছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরুপাক্ষ পাল মনে করেন, সবমিলিয়ে এটি ধনিক বান্ধব এক মুদ্রানীতি। কারণ ধনীদের ঋণে কম সুদ দিতে হবে। অর্থাৎ ৯ ভাগ। এর বিপরীতে মধ্যবিত্তদের ঋণে বেশি হারে সুদ দিতে হবে। অর্থাৎ ১২ ভাগ। তার ক্রেডিট কার্ডের সুদও বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ভোক্তা ঋণ নিয়ে থাকেন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা।
তারা ঋণ নিয়ে টিভি, ফ্রিজ, আসবাব কিংবা বিয়ের গয়নাপত্র কিনে থাকেন। তাদের দিকটা দেখা হলো না। ওদিকে দেশে মানুষের মধ্যে ক্রেডিট কার্ডে ঋণ করা বেড়ে গেছে। এমন এক সময় ক্রেডিট কার্ডে ঋণ করা বেড়েছে, যখন বাজারে সব ধরনের পণ্যমূল্য বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে।
এ কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের অনেকে ক্রেডিট কার্ডের ঋণে ঝুঁকছেন। সাধারণত ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিনা সুদে ঋণ সুবিধা মেলে। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক সামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য কেনার ক্ষেত্রে মেলে কিস্তিতে অর্থ পরিশোধের সুবিধা। আবার বিদেশ যাত্রায় বা দেশের ভেতরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে নানা ধরনের ছাড়ও পাওয়া যায় ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের ক্ষেত্রে।
এ কারণে মানুষ খরচের চাপ কমাতে বা নানা ধরনের ছাড়ের সুবিধা নিতে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৩৯ শতাংশ বেড়ে গেছে। ২০২১ সালের মে মাসে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা।
২০২২ সালের মে মাসে এ লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ ৩৮.৮২ শতাংশ বেড়ে গেছে। অথচ এ সময়ের ব্যবধানে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা বেড়েছে সাড়ে ১০ শতাংশের মতো। এপ্রিলে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা।
সর্বশেষ মে মাসে এ লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত মে মাস পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৪১ হাজার ১৬২। এপ্রিলে এ সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ ২২ হাজার ২৭৩। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১৯ হাজার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেকেই এখন ক্যাশে লেনদেন করতে চায় না। ক্যাশ বহন করতে চায় না। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কেনাকাটা প্রতি বছর বেড়ে যাচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা, কল্যাণ প্রশ্নেও ভোক্তারা এমন ঋণ নিচ্ছে। চাকরিজীবীরা এই ঋণে অধিক সুবিধা পেয়ে আসছে।
এসডব্লিউএসএস/১৩১৬
আপনার মতামত জানানঃ