হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনালকে দেয়া ১৪৩ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে বিপাকে ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল)। জনতা ব্যাংক ঋণটি অধিগ্রহণ করে নেয়ার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন এনবিএলের কর্মকর্তারা।
যদিও এর পরের বছরেই হাবিব হোটেলকে আবারো ৩০০ কোটি টাকা ঋণ দেয় ন্যাশনাল ব্যাংক। ঋণটি দেয়া হয়েছিল ‘হলিডে ইন’ নামে পরিচিত পাঁচ তারকা হোটেলটির সাজসজ্জার জন্য। মাত্র ১১ দিনে ছাড় দেয়া সে ঋণ আর ফিরে পায়নি এনবিএল।
সুদসহ ওই ঋণের পরিমাণ এখন ৪৪৩ কোটি টাকা। অনিয়মের অভিযোগে ঋণটি নিয়ে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী আলম আহমেদ বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা। ১১ জানুয়ারি ‘জনতা ব্যাংকের টাকায় কৃষক লীগ নেতার পাঁচ তারকা হোটেল; ৫৫০ কোটি টাকা এখন খেলাপি ঋণ’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশ করে গণমাধ্যম।
প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছিল জনতা ব্যাংকের ওপর পরিচালিত বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। ওই সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর আলম আহমেদ বণিক বার্তা অফিসে একটি প্রতিবাদ ও ব্যাখ্যাপত্র পাঠান।
ওই পত্রে তিনি দাবি করেন, জনতা ব্যাংক থেকে হাবিব হোটেল মোট ৩০৩ কোটি ৯৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ঋণ পেয়েছে। ঋণটি পুনঃতফসিলের জন্য বারবার জনতা ব্যাংকে আবেদন করা হলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পুনঃতফসিল করেনি।
আলম আহমেদের ব্যাখ্যা জানার পর হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনালের ঋণের বিষয়ে আরো বিস্তৃত অনুসন্ধান করেছে বণিক বার্তা। একই সঙ্গে মরিয়ম কনস্ট্রাকশনসহ আলম আহমেদের মোট ঋণের বিষয়েও খোঁজখবর নেয়া হয়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, আলম আহমেদ ও তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে বর্তমানে ব্যাংকঋণ রয়েছে ১ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। এ ঋণের বৃহদংশই বর্তমানে খেলাপি।
এর মধ্যে শুধু হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামেই ঋণ রয়েছে ১ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। এছাড়া মরিয়ম কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের নামে ৪৪৩ কোটি ও আলম আহমেদের ব্যক্তিগত নামে ১৩৪ কোটি টাকার ব্যাংকঋণ রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা, অগ্রণী ও বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকসহ আরো কয়েকটি ব্যাংকে আলম আহমেদ ও তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখার কাছ থেকে হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনালের ১৪৩ কোটি টাকার ঋণ অধিগ্রহণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। যদিও ঋণটি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছিল জনতা ব্যাংকের ক্রেডিট কমিটি। ওই ঋণের ব্যাপারে কোনো সুপারিশও ছিল না সংশ্লিষ্ট শাখার।
তার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক ও নিজেদের রীতিনীতি ভঙ্গ করে ঋণটি অধিগ্রহণ করা হয়। ঋণটি অধিগ্রহণের পর হাবিব হোটেলকে আরো ১৬০ কোটি টাকা নতুন ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি। এ ঋণ অধিগ্রহণের ক্ষেত্রেও জনতা ব্যাংক নিজেদের নীতিমালার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাও লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, শাখার সুপারিশ ছাড়াই ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখার ঋণটি জনতা ব্যাংক অধিগ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে জনতা ব্যাংকের ক্রেডিট কমিটিও নেতিবাচক মন্তব্য দিয়েছিল।
কিন্তু অধিগ্রহণসংক্রান্ত সব নীতিমালা লঙ্ঘন করে ঋণটি অধিগ্রহণ করা হয়। বর্তমানে এ ঋণের পরিমাণ ৫৫০ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে বলে জনতা ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। পুরো ঋণটিই গত বছরের সেপ্টেম্বরে খেলাপির খাতায় তুলেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি।
হাবিব হোটেলের ঋণটি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল জনতা ব্যাংক ভবন করপোরেট শাখার মাধ্যমে। ওই শাখার একাধিক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, রাজনৈতিক বিবেচনায় হাবিব হোটেলের ঋণটি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। ঋণ অধিগ্রহণের পর গ্রাহককে নতুন ঋণও দেয়া হয়।
ঋণ দেয়া ও নেয়া উভয় ক্ষেত্রেই জনতা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। আবার গ্রাহকও ঋণের অর্থ যথাযথভাবে কাজে না লাগিয়ে অন্য খাতে ব্যয় করেছেন। এ কারণেই ঋণটি পুনঃতফসিল করে দেয়ার পরও আদায় হয়নি।
জনতা ব্যাংকের কাছে নিজেদের ১৪৩ কোটি টাকার ঋণ ছেড়ে দেয়ার পরের বছরই মরিয়ম কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে ৩০০ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ঋণটি দেয়া হয়েছিল হাবিব হোটেলের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য। মূলত পাঁচ তারকা হোটেলটির আসবাব ক্রয় ও সাজসজ্জার কথা বলে ঋণটি অনুমোদন দিয়েছিল ন্যাশনাল ব্যাংক পর্ষদ। শুরুতে ২০০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেয়া হলেও অল্প সময়ের ব্যবধানে এ ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়।
চূড়ান্ত অনুমোদনের মাত্র ১১ দিনের মধ্যেই পুরো ঋণটি বিতরণ করে ন্যাশনাল ব্যাংক। যদিও ঋণ বিতরণের পর কোনো কিস্তিই পরিশোধ করেননি আলম আহমেদ। বর্তমানে সুদসহ মরিয়ম কনস্ট্রাকশনের কাছে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে নামে ৪৪৩ কোটি টাকা।
মরিয়ম কনস্ট্রাকশনকে দেয়া ঋণের বিষয়ে এরই মধ্যে তদন্তে নেমেছে দুদক। সংস্থাটির পক্ষ থেকে ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, মরিয়ম কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনালের নামে ঋণ মঞ্জুরির মাধ্যমে ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে নগদ উত্তোলন ও বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে স্থানান্তর করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ তদন্তের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংকের মোট ২০ কর্মকর্তাকে সাক্ষাৎকার দিতে দুদকে হাজির হতে নির্দেশ দেয়া হয়। এ তালিকায় ব্যাংকটির সাবেক এমডি চৌধুরী মোশতাক আহমেদ, ডিএমডি এসএসএম বুলবুল, আব্দুস সোবহান খান, শাহ সৈয়দ আব্দুল বারী ও ওয়াসিফ আলী খানের নাম রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মেহমুদ হোসেন বলেন, ‘২০১৮ সাল নাগাদ মরিয়ম কনস্ট্রাকশনের ঋণটি বিতরণ করা হয়েছিল। এ ঋণ প্রদান প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ন্যাশনাল ব্যাংকের ২০ কর্মকর্তাকে দুদকে তলব করা হয়েছে। বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন।
ওই ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। গ্রাহক ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য যোগাযোগ করেছেন। সম্প্রতি ডাউন পেমেন্ট বাবদ কিছু টাকা জমাও দিয়েছেন। তারা বলেছেন, কভিডসহ নানা কারণে ব্যবসা খারাপ ছিল। এখন হাবিব হোটেলসহ অন্যান্য ব্যবসা ভালো করছে। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়।’
আলম আহমেদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দক্ষিণগাঁওয়ে। গ্রামে মরিয়ম ভিলেজ নামে তার বিলাসবহুল একটি বাড়ি রয়েছে। আলম আহমেদ মরিয়ম এনপিএম গ্রুপ নামে একটি ব্যবসায়িক গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গ্রুপটির ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, মরিয়ম কনস্ট্রাকশন নামে গ্রুপটির ঠিকাদারি ও নির্মাণ খাতের একটি কোম্পানি রয়েছে। আর এনপিএম অ্যাপারেলস লিমিটেড নামে কাপাসিয়ায় একটি গার্মেন্টও রয়েছে। হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনালকে নিজেদের সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করেছে মরিয়ম গ্রুপ।
জানতে চাইলে আলম আহমেদ বলেন, ‘একজন গ্রাহক হিসেবে আমি ব্যাংকের কাছে ঋণের জন্য আবেদন করেছি। ব্যাংক আমার আবেদন মঞ্জুর করে ঋণ দিয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আইন অনুসরণ করেই আমাকে ঋণ দেয়া হয়েছে। ঋণ পরিশোধের একটি প্রক্রিয়া আছে। কোনো গ্রাহক খেলাপি হয়ে গেলে সে ঋণ কীভাবে পরিশোধ হবে, সে বিষয়েও আইন-কানুন আছে। আমি সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই ব্যাংকের টাকা ফেরত দেব।’
ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পর কোনো কিস্তিই পরিশোধ না করার বিষয়ে জানতে চাইলে আলম আহমেদ বলেন, ‘শত শত কিংবা হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়ে কোনো গ্রাহকই পরের বছর ফেরত দিতে পারেন না। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কিছু ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ করা হয়েছে।’
এসডব্লিউএসএস/১৬৩৫
আপনার মতামত জানানঃ