পাকিস্তানে উঠে এলো ভয়ানক দৃশ্য। সিলিন্ডারের অভাবে প্লাস্টিকের ব্যাগেই রান্নার গ্যাস ভরে বিক্রি করা হচ্ছে সেখানে। সম্প্রতি একটি ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বিশাল বড় প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা হচ্ছে রান্নার গ্যাস। আর সেই প্লাস্টিকের ব্যাগেই গ্যাস নিয়ে যাচ্ছেন গ্রাহকরা!
বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, প্লাস্টিকের ব্যাগের রান্নার গ্যাস ভরার দৃশ্য ধরা পড়েছে খাইবার পাখতুনখোয়ায়। এই প্রদেশের কারাক জেলায় ২০০৭ সাল থেকে রান্নার গ্যাস দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।
গত দুই বছর ধরে গ্যাসের পাইপলাইন খারাপ থাকায় হাঙ্গু শহরে বাসিন্দারা রান্নার গ্যাস থেকে বঞ্চিত। এরই মধ্যে খাইবার পাখতুনখোয়া থেকে এই দৃশ্য প্রকাশ্যে আসায় অনেকেই শিউরে উঠছেন। কম্প্রেসরের মাধ্যমে প্লাস্টিকের ব্যাগে গ্যাস ভরছেন বিক্রেতারা।
প্লাস্টিকের ব্যাগগুলো বিশেষভাবে তৈরি। তাতে নজেল ও ভাল্ব লাগানো রয়েছে। এক একটি ব্যাগে ৩-৪ কেজি গ্যাস ভরা হয়। সেই গ্যাস ভরতে এক ঘণ্টা সময় লাগছে বলে ওই প্রতিবেদনগুলোতে দাবি করা হয়েছে।
তবে এভাবে সিলিন্ডারের বদলে প্লাস্টিকের ব্যাগে গ্যাস ভরার প্রক্রিয়া কতটা বিপজ্জনক তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, গ্যাসভর্তি ওই প্লাস্টিকের ব্যাগগুলো এক একটি শক্তিশালী বোমার মতো।
সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া এই ভিডিওতে দেখা গেছে, বিশেষভাবে তৈরি এক একটি প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে ভালভ লাগানো রয়েছে। কম্প্রেসরের মাধ্যমে সেই প্লাস্টিকের ব্যাগে গ্যাস ভরে দিচ্ছেন বিক্রেতারা। প্রতিটি ব্যাগে ৩ থেকে ৪ কেজি করে গ্যাস ভরা হচ্ছে। এই গ্যাস ভরতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগছে। গ্যাস ভর্তি প্লাস্টিক ব্যাগগুলি থেকে যে কোনও মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। সিলিন্ডারের বদলে প্লাস্টিক ব্যাগে রান্নার গ্যাস ভরা এবং সেটি নিয়ে যাওয়া আদতেও নিরাপদ নয়।
খবর মিলেছে, এমন গ্যাসভর্তি প্লাস্টিক ব্যাগ বিস্ফোরণের জেরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে কমপক্ষে আটজন আহত হয়েছে। তাদের পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেসের বার্ন কেয়ার সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেরই অবস্থা আশঙ্কাজনক।
নাজিবুল্লাহ খান নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, কার্বন ইস্পাত বা ইস্পাতের অ্যালয় দিয়ে তৈরি গ্যাস সিলিন্ডারের দাম প্রায় ১০ হাজার পাকিস্তানি রুপি (প্রায় পাঁচ হাজার টাকা), যা অনেক পরিবার, দোকানদার এবং ব্যবসার জন্য দুর্মূল্য৷
তিনি জানান, ‘আকারের ভিত্তিতে প্রতিটি পুনরায় ব্যবহারযোগ্য গ্যাস ব্যাগের মূল্য ৫০০ থেকে ৯০০ রুপি (২৫০ থেকে ৫০০ টাকা) এবং প্রতিটি কম্প্রেসরের দাম দেড় হাজার থেকে দুই হাজার রুপি৷ শহর ও গ্রামে মানুষ উভয়ই এগুলো ব্যবহার করে’।
এ বছর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাহবাজ শরিফ ক্ষমতায় আসার পর, রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যেই দেশব্যাপী শুরু হয় এক অর্থনৈতিক সমস্যা। সে সমস্যা এখন গভীর থেকে গভীরতর। সম্প্রতি পড়শী দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার হাল দেখে পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে বাড়ছে আশঙ্কা।
পাকিস্তান থেকে দ্রুত শেষ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে আগস্টের প্রথম দিকে বৈদেশিক রিজার্ভ ছিল মাত্র ৭.৮৭ বিলিয়ন ডলারের মতো। সর্বোপরি, পাকিস্তান যে বৈদেশিক ঋণ বহন করেছে তা আশঙ্কার মাত্রা ছাড়িয়েছে। এই ঋণ তাদের বৈদেশিক মুদ্রা সরক্ষণের ক্ষমতাকে প্রতিহত করেছে।
পাকিস্তান মুসলিম লিগের নেতা তথাপি নওয়াজ শরিফের অনুজ শাহবাজ শরিফ ক্ষমতায় আসার পর, মোট ৫৩.৫ ট্রিলিয়ন পাকিস্তানি রুপির ঋণ ও দায় রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে, পিটিআই সরকারের শাসনে করে যাওয়া ২৩.৭ ট্রিলিয়ন রুপি।
বলা বাহুল্য, এই দেশটি বর্তমানে শুধু অর্থনৈতিক সংকটে নয়, একটি গভীর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেও দিয়েও যাচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার সভায় ক্রমাগত সামরিক বাহিনীর অত্যধিক ক্ষমতা প্রয়োগ ও বর্তমান সরকারের দুর্বলতার কথা বলে আসছেন একের পর এক সভায়। অর্থনীতিতে যখন ভাটা পড়েছে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তখন বেলজিয়ামের কাছ থেকে পুরোনো সি ১৩০ কিনতে বদ্ধ পরিকর। সামরিক খাতে তাদের ব্যয় আকাশছোঁয়া।
ভেঙে পড়েছে বাজার, ধস নেমেছে অর্থনীতিতে। তবে দেশটিতে অর্থনীতির এই হাল রাতারাতি হয়নি বা শুধুমাত্র শরিফের আমলে তৈরি হয়নি। এই অর্থনৈতিক বেহাল দশা কয়েক দশকের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফল। অর্থনীতির ধসের এমন কিছু কারণ রয়েছে যা পাকিস্তানকে প্রায় বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। করুণ রাজস্ব এবং অর্থপ্রদানের ভারসাম্যের ঘাটতি ছাড়াও কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ভারসাম্য সরকারের জন্য আরেকটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।
পাকিস্তানের এই সংকটের অন্যতম কারণ হলো আমদানি নির্ভরতা এবং তাদের জন্য ব্যয় করা বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অপরিহার্য। তাই তা সঞ্চয় করে রাখাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
বৈদেশিক রিজার্ভ নিঃশেষ হয়ে গেলে পাকিস্তান খাদ্যদ্রব্য, জ্বালানি এবং অত্যাবশকীয় পণ্যও আমদানি করতে পারবে না। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে।
বৈদেশিক মুদ্রা ঘাটতির অন্যতম কারণ রপ্তানি ক্ষমতার চেয়ে বেশি আমদানি। এটি স্টকে বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণ করতে পারে না। পাকিস্তান ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এবং রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছে। ক্রমবর্ধমান সংকটের মধ্যে পাকিস্তান এই অর্থবছরে গতবার প্রাপ্ত ৩১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৩৩.২ বিলিয়ন রেমিট্যান্স পাওয়ার আশা করছে।
ফ্রিবিজ এবং পপুলিস্ট নীতি শ্রীলঙ্কায় যেমন মারাত্মক অর্থনৈতিক ধ্বংসের কারণ হয়েছে, পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তা প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার উদাহরণ মাথায় রেখে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। পাকিস্তানকেও বেশিদিন অপেক্ষা করা উচিত নয়।
বছরের পর বছর ধরে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতা নির্বিশেষে সমস্ত জনতাবাদী নীতির জন্য প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয় করেছেন, যা চূড়ান্ত ব্যর্থতায় পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি সাধারণ নির্বাচনের আগে, প্রধানমন্ত্রী শরিফের সরকার এমন কিছু ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিল, যা জনগণকে খুশি করেনি। পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দেওয়া তেল ও বিদ্যুতে ভর্তুকি বাতিল করেছে এই সরকার। ১ জুলাই, নতুন সরকার পেট্রোলিয়ামের উপর একটি শুল্ক আরোপ করেছে যা মাত্র এক মাসের মধ্যে জ্বালানির দাম ৭০% বাড়িয়েছে। পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিল্পপতিরা প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের কাছে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণার দাবি তুলেছেন।
একদিকে যখন অর্থনীতির অনল গ্রাস করছে অসংখ্য মানুষের যাপন, ঠিক সে সময় সেই আগুনে ঘি ঢালল বন্যা। পাকিস্তানের সিন্ধ, দক্ষিণ পাঞ্জাব, দক্ষিণ এবং উত্তর-পূর্ব বালুচিস্তান ভয়াবহ বন্যার কবলে। বিপুল গতিতে ধাবমান জলরাশি মুছে দিচ্ছে জনবসতির চিহ্নও। প্লাবনের বলদর্পী তোড় ক্রমশ দেশটির অধিবাসীদের কাছে উষ্মার ও উৎকণ্ঠার হয়ে উঠছে। সরকার ইতিমধ্যেই জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ আশ্রয়হীন। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী এক হাজার মানুষ মারা গেছেন। প্রায় তিন হাজার কিলোমিটারের বেশি বিস্তৃত সড়কপথে ১৪৫টি সেতু ধ্বংস হয়েছে শুধুমাত্র সিন্ধ প্রদেশেই। ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অবহেলিত বালুচিস্তান প্রদেশে। পাকিস্তানের ১১৬টি জেলা, অতিবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দুর্যোগ মোকাবিলা করতে সরকার অপারগ, নেই পরিকাঠামো।
এসডব্লিউএসএস/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ