নানা সময়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলনে সীমান্তে নন-লিথ্যাল উইপন (প্রাণঘাতী নয়) অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ব্যাপারে সদিচ্ছার কথাও বলেন নীতিনির্ধারকরা।
এমনকি উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ের আলোচনায়ও সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত; কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই চোখে পড়ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় এবার বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার সীমান্ত এলাকায় দুই বাংলাদেশি নাগরিক ভারতীয় সীমান্তরক্ষা বাহিনীর বিএসএফ এর গুলিতে নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন আরো একজন।
হাতীবান্ধা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নাজির হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার ভোররাতে উপজেলার বড়খাতা ইউনিয়নের দোলাপাড়া সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে।
আহত একজনকে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। তার পায়ে গুলি লেগেছে বলে জানা যাচ্ছে। তবে বর্তমানে তিনি আশঙ্কামুক্ত।
এ ঘটনায় হতাহতরা বড়খাতা ইউনিয়নেরই বাসিন্দা। তাদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
৬১ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের উদ্ধৃতি দিয়ে হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজির হোসেন বলেন, বিজিবি এরইমধ্যে বিএসএফের সাথে যোগাযোগ করেছে।
বিএসএফ দাবি করেছে যে, হতাহতের শিকার ওই তিনজনসহ আরো কয়েক জন মিলে সীমান্ত দিয়ে গরু পারাপার করছিল। তখন তাদের লক্ষ্য করে ভারতীয় সীমান্তের দিক থেকে গুলি ছোড়ে বিএসএফ।
এ ঘটনায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিএসএফের কাছে বিজিবির পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন মি. হোসেন।
বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশিদের নিহত হওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়।
দেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের গুলিতে ১২ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরো ১৩ জন। আর আরো ৮ জন বাংলাদেশিকে অপহরণ করা হয়েছে।
খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের সাথে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতেই এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগের সীমান্ত এলাকায়ও একজন মারা গেছেন।
সীমান্তে লাশের মিছিল
মানবাধিকার সংস্থার মতে, ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দুই দশকে এক হাজার ২৩৬ জনের বেশি বাংলাদেশিকে সীমান্তে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী! এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যা করা হয়েছে ২০০৯ সালে, ৬৬ জন। এমনকি ২০২০ সালে করোনা মহামারীর মধ্যেও হত্যা করা হয়েছে ৫১ বাংলাদেশিকে।
২০২১ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএসফের গুলিতে ১৮ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এর আগে ২০২০ সালে মোট ৪৮ জন নিহত হয়েছেন। গুলিতে ৪২ জন এবং নির্যাতন চালিয়ে ছয় জনকে হত্যা করেছে বিএসএফ। অপহরণ করা হয়েছে ২২ জনকে। আহত হয়েছেন ২৬ জন।
২০১৯ সালে বিএসএফ-এর হাতে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন। এরমধ্যে গুলিতে ৩৭ জন এবং নির্যাতনে ছয়জন। অপহরণ করা হয়েছে ৩৪ জনকে। আহত হয়েছেন ৪৮ জন।
২০১৮ সালে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো ছিলো। তারপরও ওই বছর বিএসএফ সীমান্তে মোট ১৪ বাংলাদেশিকে হত্যা করে। এরমধ্যে গুলি করে আটজনকে হত্যা করা হয়। অপহরণ করা হয় ১৩ জনকে এবং আহত হন ১৫ জন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
আসকের সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন, ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বার বার সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা বন্ধ হচ্ছেনা। তারা সীমান্ত হত্যা শূণ্যে নামিয়ে আনার কথা বলার পরই আবার সীমান্ত হত্যা শুরু হয়। তাদের আচরণ দেখে মনে হয় ভারত নিজেদের প্রভু মনে করে। আর আমরা কোনো প্রতিবাদ করতে পারব না।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের সাথেও ভারতের সীমান্ত আছে। সীমান্ত সমস্যা আছে। কিন্তু সেখানে কিন্তু ভারত এভাবে গুলি চালায় না। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শুধু গরু চোরাচালান হয় না, ভারত থেকে ফেনসিডিল, মাদক এবং অবৈধ অস্ত্রও আসে। সেটা বিএসএফ দেখে না। আর গরু তো শুধু পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসে না। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসে। সেখানে কেন আটকানো হয় না?
ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ ( মাসুম) মনে করে বিএএসফ সদস্যরা যখন ঠিকমত ভাগ না পায় তখন গুলি করে। সংগঠনটির প্রধান কিরিটী রায় দাবী করেন, একদানা চিনিও বিএসএফ-এর নজর এড়িয়ে যেতে পারে না বাংলাদেশে। এরা দুর্নীতিগ্রস্ত। এদের কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত। এর প্রমাণ বার বার পাওয়া গেছে। চোরাচালান ঠেকানোর নামে তখনই তারা গুলি করে যখন তাদের ভাগ বাটোয়ারায় কম পড়ে।
তিনি বলেন, বিএসএফ শুধু বাংলাদেশিদের নয় ভারতের বাঙালিদেরও হত্যা করছে। কেন্দ্রীয় সরকার বিএসএফ-এর হাতে অনেক ক্ষমতা দিতে চায়। তারা বাংলাদেশকে বন্ধু রাষ্ট্র বলে জানালেও বাস্তবে সেটা তারা মনে করে না। আর বাংলাদেশ সরকার চুপ করে আছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের এই দুই মানবাধিকার কর্মী মনে করেন, ভারতের মুখের কথা আসলে বাস্তবে দেখা যায় না। তাই বাংলাদেশের উচিত সীমান্ত হত্যা বন্ধে আরো শক্ত অবস্থানে যাওয়া।
এসডব্লিউএসএস/০৯৪২
আপনার মতামত জানানঃ