সেপ্টেম্বরের ভয়াবহ বন্যার ‘ক্ষত’ এখনও শুকায়নি। পাশাপাশি প্রবল আর্থিক সংকটে বিধ্বস্ত পাকিস্তান। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণও কমছে দ্রুত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকেও মেলেনি সাহায্যের আশ্বাস। ফলে অর্থের জোগানে সন্ধানে এখন হন্যে পাকিস্তান।
বহুদিন ধরেই ধুঁকছে পাকিস্তানের অর্থনীতি। তবে এবার পরিস্থিতি বেশিই গুরুতর। দেশটির রিজার্ভ শেষ হওয়ার পথে। এখন যে পরিমাণ ফরেন কারেন্সি দেশটির কাছে রয়েছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ দু’মাস চলা সম্ভব। তাই যত কম আমদানি করে পারা যায়, সেই চেষ্টা করছে ইসলামাবাদ। এমনকি নাগরিকদের চা পানের পরিমাণ কমাতে বলেছে সেদেশের সরকার।
দ্য ডনের খবরে বলা হয়, গত ১২ মাসে স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের (এসবিপি) রিজার্ভ ১১.৬ বিলিয়ন ডলার কমেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ১৭.৭ বিলিয়ন ডলার; যা এখন ৬.১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ অর্থ দিয়ে এক মাসের আমদানি করতে পারবে পাকিস্তান।
পাকিস্তানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমা অব্যাহত আছে। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে, ৫৮৪ মিলিয়ন ডলার কমে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৬.১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানায়।
তারা বলছে, ২০১৪ সালের এপ্রিলের পর এটাই সবচেয়ে কম রিজার্ভ। পাশাপাশি আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২৩ অর্থবছরে এই রিজার্ভ নিয়ে পাকিস্তান তার অতিপ্রয়োজনীয় আমাদনিগুলোও পূরণ করতে পারবে না।
দ্য ডনের খবরে বলা হয়, গত ১২ মাসে স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের (এসবিপি) রিজার্ভ ১১.৬ বিলিয়ন ডলার কমেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ১৭.৭ বিলিয়ন ডলার; যা এখন ৬.১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ অর্থ দিয়ে এক মাসের আমদানি করতে পারবে পাকিস্তান।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় নেট বৈদেশিক রিজার্ভ এখন ৫.৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দেশের মোট তরল বৈদেশিক রিজার্ভ এখন ১২ বিলিয়ন ডলার।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কখন তার নবম পর্যালোচনা শেষ করবে তা এখনও স্পষ্ট না। তবে পাকিস্তানের সাবেক অর্থমন্ত্রী মিফতাহ ইসমাইলসহ বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ দাবি করেছেন, এখনও দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে আছে পাকিস্তান।
পাকিস্তান ২০১৯ সালে ৬ বিলিয়ন ডলারে আইএমএফ প্রোগ্রামে প্রবেশ করেছিল; যা চলতি বছরের শুরুতে যা ৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছিল। ১.১৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়ের জন্য আইএমএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকার এখন আলোচনা চালাচ্ছে। এ কারণে প্রোগ্রামটির নবম পর্যালোচনা মুলতুবি রয়েছে।
অনেক স্বাধীন অর্থনীতিবিদরা বিশ্বাস করেন, সরকার আইএমএফ-এর নির্ধারিত প্রাক-প্রয়োজনীয় কর্মক্ষমতা মানদণ্ডে পিছিয়ে পড়েছে।
যদিও অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারসহ একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, সৌদি আরব এবং চীন রিজার্ভ ইস্যুতে ইসলামাবাদের পাশে আছে। তবে এই ইস্যুতে এই দুই দেশ এখন পর্যন্ত কোনো নিশ্চিয়তা দেয়নি।
এদিকে রেটিং এজেন্সি এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল বলছে, তেলের দাম না কমলে বা বৈদেশিক সহায়তার উন্নতি না হলে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মধ্যে থাকবে।
‘চলতি বছরের ভয়াবহ বন্যা, ক্রমবর্ধমান খাদ্য ও জ্বালানি মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী সুদের হার ক্রমবর্ধমানসহ কয়েকটি বিষয় পাকিস্তানের অর্থনৈতিক গতিকে হতাশ করবে।’
তবে এ বিষয়ে আগাম সতর্ক করেছিল পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞরা। তারা কিছু পদক্ষেপ গ্রহণেরও পরামর্শ দিয়েছিল। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা ছিল, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আগামী দিনে সহিংসতায় রূপ নিতে পারে, যা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ পাকিস্তানের অর্থনীতি তখনই দেউলিয়া পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস নেমেছে বেশ আগেই, খাদ্য মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে বেড়েছে এবং পাকিস্তানি রুপি মুখ থুবড়ে পড়েছে। চলতি অর্থবছরে রুপির মূল্য ২১.৭২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা পাকিস্তানের আসন্ন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি আর্থিক জরুরি অবস্থার দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের পরামর্শ হচ্ছে, করপোরেট খাতে ৮০০ বিলিয়ন রুপির যে করছাড় দেওয়া হচ্ছে, তা প্রত্যাহার এবং জমি ও সম্পদ ধারণের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা উচিত। তাঁরা চান, অসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যয় হ্রাস, ১৬০০ বা তার বেশি সিসি ক্ষমতার যানবাহনের ওপর জরুরি কর আরোপ, ৮০০ বর্গগজ বা তার বেশি আয়তনের আবাসিক ভবনে বিদ্যুতের শুল্ক দ্বিগুণ করা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরের আকার ছোট করা হোক।
ইসলামাবাদভিত্তিক পাকিস্তানি রাজনৈতিক বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ এবং আর্থিক বিশ্লেষক ফারুখ সালিম এশিয়া টাইমসকে বলেছেন, ‘ডলার আসার মন্থর গতি এবং চীন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর কাছ থেকে সমর্থনের অভাবে রুপির ওপর চাপ বাড়ছে।’ তিনি জানান, ডলারের বিপরীতে রুপির দাম রেকর্ড পরিমাণে সর্বনিম্ন। দেশে স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক আরো ৯০০ পয়েন্ট হ্রাস পেয়েছে, আর্থিক বাজারে ধস নামছে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে এবং স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে (এসবিপি) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ১০.৪৪ বিলিয়ন ডলার অবশিষ্ট রয়েছে। এর মধ্যে চীন, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্যাশ ডিপোটিজ লোন রয়েছে ছয় বিলিয়ন ডলার।
এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি ক্ষমতায় আসা জোট সরকারের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস ঠেকানো সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৬ মে বেসরকারি ব্যাংকের আমানত ছাড়া পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট মজুদ ছিল মাত্র ১০.৩ বিলিয়ন ডলার, যা বড়জোর চার সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারে।
এই অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা এবং অর্থনীতির খারাপ অবস্থা অনুধাবন করে পিএমএল-এন প্রধান নওয়াজ শরিফ গত ১০ মে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং দলের ফেডারেল মন্ত্রীসহ শীর্ষ নেতাদের পরামর্শের জন্য লন্ডনে ডেকে পাঠান। দলটি ক্ষমতায় এসে এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে যে এখন তাকে অজনপ্রিয় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ভেতরের সূত্রগুলো বলছে, এই পরিস্থিতিতে ইমরান খানের শাসনকালের বিনাশী কর্মকাণ্ডের রাজনৈতিক মূল্য পরিশোধ করতে পিএমএল-এন সরকার রাজি নয়। এর চেয়ে বরং দলের হাইকমান্ড প্রদেশিক পরিষদগুলো ভেঙে দিতে এবং নতুন করে নির্বাচনের আহ্বান জানাতেই বেশি আগ্রহী হবে।
মার্চ মাসে দেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি (আমদানি-রপ্তানির ব্যবধান) প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এর ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে মোট ব্যবধান ১৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হয়ে গেছে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা গেছে, প্রথম ৯ মাসে আমদানি বেড়েছে ৪১.৩ শতাংশ। এর মধ্যে জুলাই-মার্চ সময়ে আমদানির পেছনে মোট ৬২.১৩৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে এবং এ সময়ে রপ্তানির পরিমাণ হচ্ছে ২৮.৮৫৫ বিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে মোট বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৫২ বিলিয়ন ডলারে। এই ঘাটতির কারণে পাকিস্তান আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ব্যালান্স অব পেমেন্ট সংকটে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ১৭ শতাংশের বিশাল খাদ্য মূল্যস্ফীতি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, মুদ্রাস্ফীতির আরেকটি নতুন ঢেউ আঘাত হানতে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঝোড়ো সফরে গিয়েছিলেন, কিন্তু মুক্তির উপায় লাভে ব্যর্থ হয়েছেন। আবার চীনের ঋণ নবায়নের বিষয়েও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।
এসডব্লিউএসএস/২০২৫
আপনার মতামত জানানঃ