নির্বাচনের আগে ক্রমশ জাতীয় পার্টি রাজনীতির পাদপ্রদীপের চলে এসেছে। জাতীয় পার্টিকে নিয়ে চলছে নানা রকম মেরুকরণ। আর এই রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যে জাতীয় পার্টির ভেতরের অবস্থাও টালমাটাল। বাইরের চাপে জাতীয় পার্টি ভাঙ্গনের মুখোমুখিও হতে পারে বলে মনে করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। জাতীয় পার্টিকে চাইছে এখন দুই পক্ষই এবং দুই পক্ষের কোনো পক্ষে জাতীয় পার্টি যাবে, নাকি জাতীয় পার্টির ভেঙে যাবে এটি এখন নির্বাচনের আগে সবচেয়ে বড় দেখার বিষয় বলে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল মনে করছেন।
জাতীয় পার্টি গত কিছুদিন ধরে সরকার বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। জিএম কাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই তিনি সত্যিকারের বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে প্রস্তুত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং সেই হিসেবে সংসদে এবং সংসদের বাইরে সরকারের সমালোচনা শুরু করেন। আর একারণেই জাতীয় পার্টিকে এখন আরও বেশি কাছে টানতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে জিএম কাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, মহাজোট এখন আর নেই। আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে নাও নির্বাচন করতে পারে। আর এ কারণেই সরকারের বিভিন্ন মহল জাতীয় পার্টির আওয়ামীপন্থী নেতাদের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ শুরু করেছে এবং তাদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হচ্ছে।
আর এসব নিয়েই গত পাঁচটি জাতীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টিকে (জাপা) নিয়ে নাটকীয়তার রেশ আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকলেও এবার সেই চরিত্রে রয়েছেন দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এরশাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা থাকায় আগের জাতীয় নির্বাচনগুলোর আগে কোন দল ক্ষমতায় আসবে, সেই বিষয়টি পরখ করেই এরশাদ বারবার জোটভুক্ত হয়েছেন।
১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করলেও ১৯৯৬ সালে জাপার সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। এরপর বেশ খানিকটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এরশাদ ও দলকে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে মহাজোটে যোগদান করে এরশাদের নেতৃত্বাধীন এই দল।
বদিউল আলম বলেন, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে মিগ-২৯ ও রাডার ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এরশাদের জন্য বড় ফ্যাক্ট ছিল। কারণ এই মামলায় তার বড় সাজা হওয়ার আশঙ্কা ছিল। সেটি মাথায় রেখে এরশাদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মাহাজোটে যোগ দেন।
এবার জাতীয় পার্টিকে কবজায় রাখতে বা নিয়ন্ত্রণের জন্য দলটিকে দুটি শিবিরে বিভক্ত করা ও মামলা করে দলটির চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা আগের কৌশলগুলোর চেয়ে নতুন মনে হচ্ছে বলে মনে করেন বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেন, ‘এবার দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বিভিন্ন বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, দলটি আওয়ামী লীগের সাথে না-ও থাকতে পারে। আবার দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গত দুই জাতীয় নির্বাচনে রাতের ভোট কারচুপির বিষয় নিয়ে স্পষ্ট কথা বলেছেন—যা থেকে অনুমেয়, জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে থাকছে না।
‘এ কারণেই হয়তো নানাভাবে তাকে [জাপা চেয়ারম্যান] চাপে রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধানকে আদালতের আদেশের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার ঘটনা এটিই প্রথম।’
২০১৯ সালের মৃত্যুবরণ করেন হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। এরপর দলেটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তার ছোট ভাই জিএম কাদের। কিন্তু অভিযোগ আছে, দলটি জিএম কাদের ও এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই দুটি গ্রুপের নানা কার্যক্রম এখন রাজনৈতিক আলোচনার তুঙ্গে।
এর মধ্যে গত বুধবার রাতে হঠাৎ করেই দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করে একটি পক্ষ। যদিও এ ঘোষণার দেড় ঘণ্টা পর তা স্থগিত করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এর আগে গত মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) দলের চলমান বিরোধ নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তার কার্যালয়ে গিয়েছিলেন রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের। কিন্ত সেই সক্ষাতের কোনো ফলাফল এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
জাপার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি টিবিএসকে বলেন, ‘এরশাদারে সময় বা পরে নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি জোটভুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক পলিসিরি কারণে। এখানে কোনো চাপ, ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থ বিচেনা করে জোটভুক্ত হয়নি।
‘তবে ২০১৮-র নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির সাথে আওয়ামী লীগের আচরণ একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। আগামী নির্বাচনে আমরা আওয়ামী লীগের সাথে থাকব কি না, সেটি সময়ই বলে দেবে। মানুষের ভোটের অধিকার, মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের অধিকারসহ সকল দিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এজন্য দলীয় প্রধান যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটিই চূড়ান্ত।’
মামলার মাধ্যমে দলের প্রধান জিএম কাদেরকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার বিষয়ে এই নেতা বলেন, তাদের দল এখনও জিএম কাদেরের সিদ্ধান্তেই দল পরিচালনা করবে।
জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি থেকে সদ্য অবসর পাওয়া মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা টিবিএসকে বলেন, ‘আমি এখনো জাতীয় পার্টির সাথে আছি। নির্বাচনের আগে দল যে সিদ্ধান্ত নেবে সে অনুযায়ী কাজ করব।’
মামলা করে জিএম কাদেরকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি একটি আইনি প্রক্রিয়া। কেউ আইন লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়াই স্বাভাবিক। এখানে অন্য কোনো কিছুই নেই।’
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, জাতীয় পার্টিতে রওশন এরশাদ আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত।
তবে রওশন এরশাদ এখন অসুস্থতার কারণে নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে জাতীয় পার্টিতে আওয়ামীবিরোধী অংশ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে বলে অনেকেই ধারণা করছেন।
এরকম পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালের শেষ দিকে অথবা ২০২৪-এর শুরুর দিকে অনুষ্ঠিতব্য আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী হবে, সেটি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী আলোচনা চলছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবউল আলম হানিফ টিবিএসকে বলেন, জাতীয় পার্টি এখনও মাহাজোটে আছে।
তিনি বলেন, ‘জোটে থাকার পরও ওই দলে একটি চক্র নানা কৌশলে সরকার হটানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত। তারা বিরোধী দল হিসেবে কার্যক্রম পরিচালন করবে। তবে এটি মাথায় রাখতে হবে, তারা বিরোধী দলে কীভাবে স্থান পেয়েছে।’
জাতীয় পার্টির একাধিক নেতাকর্মী জানান, বর্তমানে দলে তিনটি গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। এক গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক। অন্য গ্রুপে বেগম রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা। অপর গ্রুপে এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সাখাওয়াত হোসেন টিবিএসকে বলেন, জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টি বরাবরই ট্রাম্প কার্ডের ভূমিকায় থাকছে। ফলে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে নানা দিক বিবেচনায় তারাও নানা কৌশলে এগোয়। তবে অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, জাতীয় পার্টি সবসময় সুবিধাজনক অবস্থা বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়। অনেকসময় নানা চাপও দেখা গেছে তাদের ওপর।
আগামী নির্বাচন উপলক্ষে জাতীয় পার্টির সিদ্ধান্ত আগের মতোই হচ্ছে কি না, তা সময়ই বলে দেবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এসডব্লিউএসএস/১১৩৫
আপনার মতামত জানানঃ