যুক্তরাষ্ট্রে একটি নতুন সমীক্ষায় জানানো হয়, গত ৩০ বছরে দেশটিতে বন্দুক হামলায় ১০ লাখেরও বেশি লোক নিহত হয়েছেন। দ্য হিলের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আগ্নেয়াস্ত্র সংক্রান্ত ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১১ লাখ ১০ হাজার মানুষ মারা গেছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৮৬ শতাংশ পুরুষ।
আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের ওপেন-অ্যাক্সেস মেডিকেল জার্নাল জেএএমএ নেটওয়ার্ক ওপেনে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণায় এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের তথ্যের বরাত দিয়ে সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানায়, এ বছরের ২২ নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৬০৭টি বন্দুক হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তিন হাজার ১৭৯ জন। এর মধ্যে ৬৩৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আড়াই হাজারের বেশি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রে মৃত্যু হার কমে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১০ জন।
২০১০ সালে এই হার আবার বাড়তে শুরু করে। অবশেষে ৪৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালে প্রতি ১ লাখে আগ্নেয়াস্ত্রে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪.৭ জন। সমীক্ষায় দেখা যায়, জাতিগত বৈষম্যের কারণে আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট ঘটনায় মৃত্যুর হার বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বন্ধুক হামলা প্রায়ই ঘটে। তবে অস্ত্র আইনে বড় পরিবর্তন আনেনি রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট… কোনো সরকারই।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৩২ কোটি নাগরিকের হাতে ৩৯ বন্দুক কোটি আছে। এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে একটি প্রতিবেদনও ছেপেছে সিডিসি।
প্রসঙ্গত, সিডিসির হিসাবে, ২০২০ সালে গুলিতে প্রান হারিয়েছে চার হাজার ৩০০ শিশু। তাদের বয়স ১-১৯ বছরের মধ্যে। ২০১৯ সালের চেয়ে যা ৩৩.৪ শতাংশ বেশি।
সিডিসি বলছে, দেশে ২৯.৫ শতাংশ শিশু, কিশোররা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। গুলিতে মৃত্যুর ঘটনাগুলোর মধ্যে আছে খুন, আত্মহত্যা, অনিচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহত্যার হার বাড়ে ১ দশমিক ১ শতাংশ।
আইনিভাবে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার সুযোগ প্রায় অবাধ বলে এসব ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করছেন অনেক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এসব ঘটনার মূল কারণ বিনামূল্যে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়ার সুবিধা। যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের দাবি বিভিন্ন সময়ে উত্থাপিত হলেও, প্রস্তুতকারকদের কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তরুণ আমেরিকানদের মৃত্যুর প্রধান কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। তার পরেই আছে বন্দুক হামলায় মৃত্যু। সময়ের সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমলেও, আগ্নেয়াস্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণের অভাবে বন্দুকের ব্যবহার বাড়ছে।
‘আমরা আমাদের শিশুদের মৃত্যু থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছি; অথচ এটা প্রতিরোধ সম্ভব।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে লাগাতার বন্দুক সহিংসতার ঘটনায় উদ্বিগ্ন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিজ দেশের ভ্রমণকারীদের প্রয়োজনীয় সতর্কতা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। এ তালিকায় রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান এমনকি ইসরাইলও।
অস্ট্রেলিয়া থেকে যারা যুক্তরাষ্ট্রে যেতে আগ্রহী তাদের স্থানীয় নির্দেশনা ও নিয়মকানুন মেনে চলার তাগিদ দিয়েছে দেশটির সরকার। নিজ দেশের নাগরিকদের রাতে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে ভ্রমণ না করার আহ্বান জানিয়েছে কানাডা সরকার। একই নির্দেশনা দিয়ে নির্জন এলাকায় একা চলাচল না করার পরামর্শ দিয়েছে ব্রিটেন সরকার।
পর্যটন খাতকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে। তবে জার্মানিও তার নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সতর্কতা মেনে চলার কথা জানিয়েছে। একই পরামর্শ দিয়েছে জাপান, নিউজিল্যান্ড ও মেক্সিকো। এছাড়া দৃঢ় সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলেছে ইসরাইল।
এই সকল হামলার বিষয়ে মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক লিসা পেসকারা-কোভাখ বলেন, ‘‘ইস্যুটি গুরুতর মানসিক সমস্যা নয়৷ এই (হামলাকারী) ব্যক্তিরা নিরাশ, হতাশাগ্রস্ত এবং আত্মহত্যাপ্রবণ ছিল৷”
তিনি জানান, অনেক তরুণ বন্দুকবাজের ক্ষেত্রে ‘আত্মপরিচয়ের সংকট’, ‘শরীরের ইমেজ সম্পর্কে নিরাপত্তাহীনতা’ ছিল৷ সেই সঙ্গে তারা চরমপন্থি দৃষ্টিভঙ্গি এবং নাৎসি ও অতি পৌরুষ ভাবমূর্তির প্রতি আকৃষ্ট ছিল৷
খ্যাতি এবং দৃষ্টি আকর্ষণও তাদের একটি সচরাচর উদ্দেশ্য৷ পেসকারা-কোভাখ বলেন, ‘‘অনেক সময় অপরাধ সংঘটনকারী মনে করেন তাদের জীবন ছোট৷ কিন্তু তারা বড় কিছুর অংশীদার হতে চান৷ তারা ইতিহাসের অংশীদার হতে চান৷”
এমন হামলা ঠেকানোর উপায় কী? তার মতে, ঝুঁকির কারণগুলো কমাতে হবে৷ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা আরো সহজলভ্য করতে হবে৷ কিন্ত তাই বলে মানুসিক রোগ এবং মনস্ত্বাত্ত্বিক পরীক্ষার সঙ্গে সহিংসতার ঝুঁকি এবং হুমকি মূল্যায়নকে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয় বলে মনে করেন এই মনরোগ গবেষক৷
এসডব্লিউ/এসএস/১০৩৫
আপনার মতামত জানানঃ