টানা ছয় বছর দায়িত্ব পালন শেষে আগামী ২৯ নভেম্বর অবসরে যাচ্ছেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া। তবে সেনাপ্রধান হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার সপ্তাহ মাত্র দুই আগে সামনে এসেছে বিস্ফোরক তথ্য। পাকিস্তানভিত্তিক অনুসন্ধানমূলক প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্ট ফোকাস জানিয়েছে, গত ছয় বছরে বিলিয়নিয়ারের খাতায় নাম লিখিয়েছেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের পরিবারের সদস্যরা।
পাকিস্তান সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার পরিবারের ‘বিপুল সম্পদের তথ্য’ ফাঁস করেছে একটি অনুসন্ধানী নিউজ ওয়েবসাইট। কর নথির বরাত দিয়ে ওয়েবসাইটটি এই তথ্য দেওয়ার দাবি করেছে। বেআইনিভাবে কর নথি ফাঁসের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির অর্থমন্ত্রী ইসহাক দার।
ডনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাপ্রধান বাজওয়ার পরিবারের কর নথি ‘বেআইনি ও অন্যায্যভাবে’ ফাঁসের বিষয়টি গতকাল সোমবার গুরুত্বের সঙ্গে নেন অর্থমন্ত্রী। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এটি আইনে দেওয়া কর তথ্যের সম্পূর্ণ গোপনীয়তার স্পষ্ট লঙ্ঘন।’
আগের দিনই কথিত কর রিটার্ন ও সম্পদের তথ্যের বরাত দিয়ে নিউজ ওয়েবসাইট ফ্যাক্টফোকাসের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, সেনাপ্রধানের পরিবার গত ছয় বছরে কয়েক শ কোটি রুপির সম্পদ গড়ে তুলেছে।
মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, আজ অবধি অজানা কর্মচারীদের পক্ষ থেকে এই গুরুতর ত্রুটির পরিপ্রেক্ষিতে কর আইনের লঙ্ঘন, কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ডের (এফবিআর) তথ্য হাতিয়ে নেওয়া ও অর্পিত দায়িত্ব ভঙ্গের বিষয়টি তদন্তে ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দিতে প্রধানমন্ত্রীর রাজস্ববিষয়ক বিশেষ সহকারী তারিক মাহমুদ পাশাকে নির্দেশনা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
ফ্যাক্টফোকাস নিজেদের ‘পাকিস্তানভিত্তিক ডিজিটাল মিডিয়া’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। তারা ডেটা-নির্ভর অনুসন্ধানী সংবাদ প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করে আসছে বলে সংবাদ প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে।
অতীতে এই ওয়েবসাইট পাকিস্তানের কয়েকজন রাজনীতিক ও অন্যান্য খাতের ‘তহবিল তছরুপ’ নিয়ে বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন—পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান ও সাবেক স্বৈরশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ।
২০২০ সালে এই ওয়েবসাইট অফশোর কোম্পানিতে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর অথোরিটির সাবেক চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আসিম সালিম বাজওয়া ও তাঁর পরিবারের কথিত সম্পদ ও ব্যবসা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
গত বছর ওয়েবসাইটটি দাবি করেছিল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও তাঁর মেয়ে মরিয়াম নওয়াজকে দোষী সাব্যস্ত করতে সাবেক প্রধান বিচারপতি সাকিব নিসার নির্দেশ দিয়েছেন, এমন একটি অডিও তারা পেয়েছে।
সেনাপ্রধান বাজওয়ার পরিবারের কথিত কর নথি–সম্পর্কিত ফ্যাক্টফোকাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের বাইরে মিলিয়ে সেনাপ্রধানের জ্ঞাত সম্পদ ও ব্যবসার পরিমাণ ১ হাজার ২৭০ কোটি রুপি।
প্রতিবেদনে ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল নাগাদ জেনারেল বাজওয়া ও তাঁর পরিবারের জমা দেওয়া কথিত সম্পদের তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ২০১৬ থেকে ৬ বছরে জেনারেল বাজওয়ার স্ত্রী আয়েশা আমজাদের (ঘোষিত ও জ্ঞাত) সম্পদের পরিমাণ শূন্য থেকে ২২০ কোটি রুপিতে গিয়ে ঠেকেছে। এতে বলা হয়, এই সম্পদের মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে তাঁর স্বামীকে দেওয়া আবাসিক প্লট, বাণিজ্যিক প্লট ও বাড়িগুলো হিসাবে ধরা হয়নি।
প্রতিবেদনে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, জেনারেল বাজওয়ার পুত্রবধূ মাহনুর সাবিরের ঘোষিত সম্পদের পরিমাণ ২০১৮ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ছিল শূন্য। পরে ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর তা ১ হাজার ২৭১ মিলিয়ন (প্রায় ১২৭ কোটি) রুপিতে গিয়ে দাঁড়ায়। মাহনুরের বোন হামনা নাসিরের সম্পদ ২০১৬ সালে ছিল শূন্য, যা পরের বছর ‘কয়েক শ’ রুপিতে গিয়ে ঠেকে।
সেনাপ্রধানের বেয়াই সাবির হামিদের ২০১৩ সালের কর রিটার্ন ছিল ১০ লাখ রুপিরও কম। আসছে বছরগুলোতে তিনিও শতকোটি টাকার মালিক হতে যাচ্ছেন বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
ফ্যাক্টফোকাসের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাজওয়ার দুই ছেলের সম্পদের তথ্য পেতে তারা সমর্থ হয়নি। সংবাদমাধ্যমটি দাবি করেছে, প্রতিবেদনটি প্রকাশ করার পর তাদের ওয়েবসাইটে পাঠকদের প্রবেশ ‘বিঘ্নিত’ হয়। তাদের ওয়েবসাইটটি ‘বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে’ বলেও সংবাদমাধ্যমটি দাবি করেছে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর প্রায় অর্ধেক সময়জুড়ে দেশটি শাসন করেছে সেনাবাহিনী। অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচিত সরকারের চাইতেও সামরিক বাহিনীকে অধিক ক্ষমতাবান মনে করা হয়। ফলে এই বাহিনীর বিষয়ে কোনও রিপোর্ট করাকে দেশটিতে অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় বলে মনে করা হয়।
এদিকে জেনারেল বাজওয়ার পরিবারের সদস্যদের এমন আর্থিক বিবরণী সামনে আসার পর বিষয়টি নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ইসহাক দার। গোপনীয় ট্যাক্স নথি কিভাবে ফাঁস হলো ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেটিও খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অর্থমন্ত্রী ইসহাক দার সেনাপ্রধানের পরিবারের সদস্যদের ট্যাক্সের তথ্য ফাঁসের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন।
সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের তরফে এ বিষয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিডিয়া উইংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির বিষয়টি উল্লেখ করেছে।
এসডব্লিউএসএস/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ