উন্নয়নশীল দেশে দূর্নীতি একটি মারাত্মক রোগের নাম। দূর্নীতি ও অনিয়মের কারণে দেশের সার্বিক উন্নয়ন যথেষ্ট পরিমাণে বাঁধাগ্ৰস্থ হয়। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি খাতে দূর্নীতি একটি সাধারণ বিষয়। বাংলাদেশ সরকার সব ধরনের দূর্নীতি ও অনিয়ম দূর করার জন্য একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী কমিশন গঠন করেছিল যা দূর্নীতি দমন কমিশন নামে পরিচিত।
তবে এই মুহূর্তে প্রশ্ন উঠছে দুদকের সক্ষমতা নিয়ে। বাংলাদেশে যে প্রত্যাশা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিত হয়েছিল, সেটা খুব একটা পূরণ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠ
কারণ দেশে এখন নানামুখী সংকট। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কমেছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের কাছ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছে অথচ দেশের টাকায় যাদের ঋণ দেওয়া হয়েছে তারা ঠিকমতো তা পরিশোধ করেননি। এতে শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যাংককেই বিপদে ফেলেননি ঋণ খেলাপিরা। বিপদে ফেলেছেন বাংলাদেশকে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেউ কেউ আবার তা পুরোটাই গায়েব করে ফেলেছেন।
রাষ্ট্রের দুর্নীতি নির্মূলের জন্য আইনি প্রতিষ্ঠান দুদক। কিন্তু দুর্নীতি নির্মূলে দুদক কী করছে এমন প্রশ্ন হরহামেশা ওঠে। আমরা দেখেছি, করোনায় দুদকের কার্যক্রমে ব্যাপক ভাটা পড়ে। করোনার ধাক্কা সামলে উঠেছে বাংলাদেশ কিন্তু দুদক সেই ঝিমিয়েই আছে। এখন সপ্তাহে নামকাওয়াস্তে কিছু মামলা, চার্জশিট দিয়েই চলে দুদকের কার্যক্রম।
আসামিদের গ্রেপ্তারে তৎপর নেই রাষ্ট্রের দুর্নীতি দমনকারী সংস্থার। দুই-তিন বছরে দুদকের মামলা-চার্জশিটভুক্ত যেসব আসামি এখন জেলে রয়েছেন তারা সরাসরি আদালতে জামিন না পেয়েই জেলখানায় আছেন। দুদক এখন তাদের মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করছে না।
আগে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি, ডেসটিনিকাণ্ডসহ নানা দুর্নীতির ঘটনায় মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেছে দুদক। সেই বিশ্বাস এখন যেন ফিকে। দুদক আগে আসামি গ্রেপ্তার করে আদালতে তুলতো। তারপর আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী জেলখানায় পাঠাতো। এখন কিছু আসামি জামিন না নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরলেও দুদকের দেখা নেই।
দুদক আগে আসামি গ্রেপ্তার করে আদালতে তুলতো। তারপর আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী জেলখানায় পাঠাতো। এখন কিছু আসামি জামিন না নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরলেও দুদকের দেখা নেই।
আদালতে গেলে জামিন নাও পেতে পারেন তাই আসামিরা জামিন না নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আসামিরাও জানেন এখনকার দুদক গ্রেপ্তার করবে না। এতে দুর্নীতি মামলার আসামিদের কাছে বার্তা যাচ্ছে যে, দুদকের মামলায় কিছু হয় না। এতে সমাজে এমন বার্তা যায় যে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দুর্নীতি করলে তেমন কিছু হয় না।
গণমাধ্যমে প্রতিদিন অসংখ্য দুর্নীতির প্রতিবেদন আসছে কিন্তু দুদক অনেক অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিচ্ছে না। লিখিতভাবে এবং দুদকের টোল ফ্রি নম্বর ১০৬-এ প্রতিদিন আসছে অসংখ্য অভিযোগ। যদিও যেসব অভিযোগ দুদকে আসে তার সবই দুদকের তফসিলভুক্ত নয়; অনেক অভিযোগ আসে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে কিন্তু দুদকের তফসিলভুক্ত যেসব অভিযোগ তার প্রায় কত শতাংশ যাচাই বাছাই করে আমলে নেওয়া হচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর দুদকের জনসংযোগ বিভাগ কিংবা সংস্থার ওয়েবসাইটেও নেই।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান দুদকের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতিবাজদের জোরালো কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি যা ভিক্ষা করে আনি সব চাটার গোষ্ঠী খেয়ে ফেলে, আমার গরিব কিছুই পায় না।’
দুর্নীতিবাজদের তিনি সমাজ থেকে উৎখাত করতে বলেছেন। বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন।
শুধু দুদকের পক্ষে দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল সম্ভব না কিন্তু দুর্নীতি দমনে সংস্থার আন্তরিক সদিচ্ছা কতটুকু? কয়েকমাসে দুদকে অনেক নতুন লোকবল নিয়োগ হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় দুদকের শাখা অফিস খোলা হয়েছে। এখন রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয় এবং বিভাগীয় কার্যালয় ছাড়াও সারাদেশে সংস্থার ৩৬টি অফিস রয়েছে।
যেসব জেলায় দুদকের কার্যালয় নেই সেসব জায়গায়ও অফিস খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। একের পর এক দুদকের শাখা বাড়ছে কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিএফআই-এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ১০ বছরে পাচার হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ বাংলাদেশের দুটি বাজেটের সমান।
দেশ থেকে অর্থ পাচার হলেও এসব পাচারের বিরুদ্ধে তদন্ত করার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। অথচ, দুদকই দাবি করে, তারাই একমাত্র সফল প্রতিষ্ঠান যারা দশ বছর আগে বিএনপি চেয়ারপাসন খালেদা জিয়ার ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমানের পাচারের অর্থ সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত এনেছে। পাচার হওয়া অর্থ যে ফেরত আনা যায় তারতো নজির গড়েছে দুদক, তাহলে এখন কেন পারছে না?
এক চেয়ারম্যান এবং দুই কমিশনার মিলেই গঠিত কমিশন। দুদকের সার্বিক কার্যক্রম এই তিনজনের অর্থাৎ কমিশনের নির্দেশনায় হয়। সংস্থার বর্তমান চেয়ারম্যান এবং দুই কমিশনার সমাজে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত।
তারা ইতিপূর্বে যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে শোনা যায়। কর্মজীবনে তাদের সেই সততার প্রতিফলন মানুষ দেখতে চায়। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণা আর আইনের সঠিক প্রয়োগে দুদকের পক্ষে দেশ থেকে অনেকাংশে দুর্নীতি কমানো সম্ভব।
এই মুহূর্তে দুর্নীতি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। দেশ এখন দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন না হলেও শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্থ দেশগুলোর তালিকায় রয়ে গেছে।
সর্বশেষ টিআইবি’র খানা জরিপেও সেবাখাতে ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব দুদকের। সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে, জনগণের করের টাকায় চলা এই প্রতিষ্ঠান দেশের দুর্নীতি নির্মূলে কাজ করবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ