সম্প্রতি জাতীয় পার্টির (জাপা) শীর্ষ নেতাদের ধারালো কথাবার্তা গণমাধ্যমে আসছে। এ অবস্থা এক বছর আগেও দেখা যায়নি। বলতে গেলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর এই প্রথম দলটির নেতারা এ ভাষায় কথা বলা শুরু করে।
গত সেপ্টেম্বর মাসে জাপা মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু গণমাধ্যমকে বলেন, পাস্ট ইজ পাস্ট। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিলাম; তা এখন দূর অতীত। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই আমরা তাদের সঙ্গে নেই। আগামী নির্বাচনেও থাকব না। আমরা এককভাবে নির্বাচন করব। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের বাইরে গিয়ে জাতীয় নির্বাচন করা কঠিন চ্যালেঞ্জ বলে মানছেন তিনি। জাপার একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য সময়ের আলোর কাছে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির কারণ জানান।
তিনি বলেন, ‘গত একাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির নির্বাচনি সমঝোতা হয়েছিল। সে কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এখন তা অনেকটাই নেই। উপজেলা নির্বাচনে তাদের প্রার্থীদের এলাকা ছাড়া করে আওয়ামী লীগ। অনেক জায়গায় হামলা-নির্যাতন চালায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আমাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি সরকারি দলের লোকেরা। এতে চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন তৃণমূলের নেতারা। বিএনপির কথা বাদই দিলাম আমাদের মিত্র খোদ আওয়ামী লীগের নেতারাই আমাদেরকে গৃহপালিত বিরোধীদল বলে ইমেজ নষ্ট করে।’
এই নেতার ভাষ্য-সরকারের কথামতো না চলায় অর্থাৎ গঠনমূলক বিরোধিতা করায় তাদের ওপর পরোক্ষভাবে খড়গ নেমে এসেছে। দলের এমপিরাও অনেকটা নাখোশ। এই পর্যায়ে এসে তারা ভিন্ন চিন্তার কথা বলছেন। ব্যাটে-বলে মিললে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনি জোট করতে আপত্তি নেই তাদের। বিএনপির সঙ্গে জোট করার চিন্তা করছে জাতীয় পার্টি। এমনকি তারা বিএনপির নেতৃত্বে সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্যে থাকতে তৎপরতা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে।
মূলত সরকারের ‘ভুলত্রুটি’ নিয়ে বছরখানেক ধরে জি এম কাদেরের বক্তব্য এবং তার রাজনৈতিক অবস্থান আলোচনায় এনেছিল জাতীয় পার্টিকে (জাপা)। সম্প্রতি সিদ্ধান্ত গ্রহণে জি এম কাদেরের ওপর আদালতের এক অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা হঠাৎ করেই যেন চুপসে দিয়েছে জাপাকে।
এ অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চেয়ে জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের যে আবেদন করেছেন, তার ওপর শুনানি শেষে আগামীকাল বুধবার আদেশের দিন রেখেছেন আদালত। জাপার দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন, বিষয়টি আইনি হলেও এর ভেতরে বিশেষ রাজনৈতিক ‘বার্তাও’ আছে। এটা নির্বাচন পর্যন্ত জাপাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল হতে পারে সরকারের।
জাপা দলীয় সূত্র জানায়, দ্রুত সময়ের মধ্যে বিষয়টির নিষ্পত্তি না হলে বা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশটি আরও কিছুদিন বহাল থাকলে দলে জটিলতা বাড়বে। কারণ, ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন আগামী ২৭ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। ২৯ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। তার আগেই জি এম কাদেরের ওপর আদালতের দেওয়া অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশটি প্রত্যাহার না হলে রংপুরে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন ফরমে তিনি স্বাক্ষর দিতে পারবেন না।
সে ক্ষেত্রে দলের দ্বিতীয় প্রধান বা মহাসচিবকে মনোনয়ন ফরমে সই দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি যদি এ পর্যন্ত গড়ায়, তাতে নানা বিভাজনের মধ্যে থাকা দলটির উচ্চপর্যায়ে সন্দেহ ও অবিশ্বাস আরও বেড়ে যেতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাপার একজন কো–চেয়ারম্যান গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আশা করেন, ১৬ নভেম্বরেই এর নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। চেয়ারম্যানই মনোনয়ন ফরমে সই করবেন। যদি নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি সই করতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে মহাসচিব মনোনয়ন ফরমে সই করবেন।
গত রোববার জাপা রংপুর সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র মোস্তাফিজার রহমানকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের পক্ষে মহাসচিব মজিবুল হক এ মনোনয়ন ঘোষণা করেন। এখন ২৯ নভেম্বরের আগে জি এম কাদেরের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার নিষ্পত্তি না হলে নেতা-কর্মীদের কাছে এর ‘ভিন্ন বার্তা’ যাবে বলে মনে করছেন জাপার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা।
জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরকে অবৈধ ঘোষণার আদেশ চেয়ে ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলাটি করেছিলেন দল থেকে বহিষ্কৃত নেতা জিয়াউল হক। গত ৩১ অক্টোবর আদালত জি এম কাদেরের ওপর ওই অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন। এর পর থেকে জি এম কাদের চুপচাপ রয়েছেন। এ ঘটনায় জাপার উচ্চপর্যায়ের নেতারাও হতচকিত। তাঁরা ভাবতে পারেননি দলীয় প্রধানের ওপর আদালত থেকে এত কঠোর সিদ্ধান্ত আসবে এবং তা এত দিন পর্যন্ত গড়াবে।
একই আদালতে জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে একই ধরনের আরেকটি মামলা রয়েছে। মামলাটি করেছেন জাপার প্রেসিডিয়ামের সদস্য পদ থেকে আরেক বহিষ্কৃত নেতা মসিউর রহমান। তিনিও চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরকে অবৈধ ঘোষণার আদেশ চেয়েছেন। এ মামলায় আগামী ২ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য রয়েছে বলে আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
দলীয় প্রধানের বিরুদ্ধে একের পর এক হয়রানিমূলক মামলায় হতাশা প্রকাশ করেন জাপার কো–চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে জাতীয় পার্টি নিয়ে যা হচ্ছে, যদিও এটা সাময়িক, তবু এটা দুঃখজনক। এ ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা হওয়া উচিত নয়। জাতীয় পার্টির নাম করে যাঁরা এগুলো করছেন, এটা আত্মঘাতী কাজ।’
জাপার দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, একটি রাজনৈতিক দল পরিচালিত হয় কার্যত দলীয় প্রধানকে সামনে রেখে। তা ছাড়া জাপা সংসদে প্রধান বিরোধী দল। এ দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের, যিনি সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা। সেখানে দেশের প্রধান বিরোধী দলের প্রধানকে তাঁর দলীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিবৃত্ত রাখা একটি নজিরবিহীন ঘটনা। তাই জি এম কাদেরের ওপর আরোপ করা আদালতের নিষেধাজ্ঞাটিকে হালকাভাবে দেখছেন না জাপার নেতারা।
জাপার বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে অবৈধ ঘোষণা করতে একাধিক মামলা দায়ের, একটি মামলায় তাঁকে দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে নিবৃত্ত রাখা, তারও আগে জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার সংসদীয় দলের প্রস্তাব স্পিকারের দপ্তরে ঝুলে থাকা, সর্বশেষ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে দলের মনোনয়ন–বাণিজ্যসম্পর্কিত একটি অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে দুদককে হাইকোর্টের নির্দেশ—এ তিন ঘটনার উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন বলে মনে করছেন দলের নেতা-কর্মীদের অনেকে। আর তা হচ্ছে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত জাপাকে হাতের কবজায় রাখা।
দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, ১৬ নভেম্বর যদি নিষেধাজ্ঞার নিষ্পত্তি না হয় এবং তা ঝুলিয়ে রাখা হয়, তাহলে এর পেছনে যে সরকারের হাত রয়েছে, তা মানুষের কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে। তাতে শেষ বিচারে সরকারেরই ক্ষতি। মানুষ বুঝবে, সরকার আদালতকে ব্যবহার করে জাতীয় পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
এ বিষয়ে জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘রাজনীতিতে জাপা তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছিল। জনগণের মধ্যে একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করেছি। এখন সেটাকে দমিয়ে রাখার অপচেষ্টা চলছে বলে মনে হচ্ছে।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৪৫
আপনার মতামত জানানঃ