অনেক দিন ধরেই গুঞ্জন চলেছিল এশিয়ার গণমাধ্যমে। এবার চীন সাগরের একাধিক দ্বীপের গোপন নৌঘাঁটিতে চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মির সমরসজ্জার ছবি সামনে আনলো চিত্র সংবাদ সংস্থা গেটি ইমেজেস।
গেটির চিত্রগ্রাহক এজরা আকায়ান আকাশপথে নজরদারি চালিয়ে চীনা যুদ্ধবিমানের হ্যাঙ্গার, এয়ার স্ট্রিপ, ক্ষেপণাস্ত্রবাহী জাহাজ, এমনকি ডুবোজাহাজের গোপন ঘাঁটির খোঁজও পেয়েছেন। তিনি তুলে এনেছেন বেশ কিছু ছবি।
এদিকে, দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত এলাকায় চীনের কৃত্রিম দ্বীপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের অভিযোগ, সেখানে সামরিক ঘাঁটি তৈরির পাশাপাশি চীন জলপথ ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে জাপান দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বীপগুলো দখল করে নেয়। জাপানের পরাজয়ের পর ১৯৪৩ ও ১৯৪৫ সালের কায়রো ও পটসডাম ঘোষণার মাধ্যমে দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বীপগুলোয় প্রজাতন্ত্রী চীনের অধিকার স্বীকৃত হয়। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন জাতীয়তাবাদী চীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ১৫৯ দ্বীপ, ক্ষুদ্রদ্বীপ ও বালুচর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের আওতাধীন করে নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময় থেকে আজ পর্যন্ত সঙ্ঘটিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলি দক্ষিণ চীন সাগরকে বর্তমান দুনিয়ার উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত করেছে।
দক্ষিণ চীন সাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোর মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের প্রশ্নে বড় ধরনের বিরোধ রয়েছে। মতবিরোধের মূল কারণ, দক্ষিণ চীন সাগরের ৮০ শতাংশের ওপর চীন তার সার্বভৌমত্ব দাবি করছে, যা উপকূলবর্তী অন্য দেশগুলোর জন্য উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে লেখক রবার্ট ফারলি দি ন্যাশনাল ইন্টারেস্টে এক ব্লগে লিখেছেন, দক্ষিণ চীন সাগরে মূলত স্প্রেটলি এবং প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জে অসংখ্য সামরিক স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করেছে চীন। স্প্রেটলিসে চীন কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা, হেলিকপ্টার পরিকাঠামো ও এয়ারফিল্ড তৈরি করেছে। চীন এই অঞ্চল জুড়ে নির্মাণ চালিয়ে যাচ্ছে। বৃহত্তর ঘাঁটিগুলিতে সামরিক বিমান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে সেনা ও বৃহত্তর টহল দল। এর অর্থ হচ্ছে, চীন ভবিষ্যতে তার সামরিক ঘাঁটির প্রসার করবে।
দক্ষিণ চীন সাগরের ওই বিতর্কিত অঞ্চলে প্রতিপত্তি বজায় রাখার জন্য দীর্ঘ দিন ধরেই সক্রিয় চীন। তবে প্রবালপ্রাচীরে ঘেরা ছোট্ট পাথুরে দ্বীপগুলোতে সামরিক ঘাঁটি বানানোর কথা কখনওই স্বীকার করেনি তারা।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের দাবি, মিসচিফ রিভ, গাভেন রিফস, সুবি রিফ, কুয়ার্টেরন রিফ, হিউজ রিফের মতো প্রবালপ্রাচীরের উপর বানানো কৃত্রিম দ্বীপগুলোতে চীনা ফৌজের নৌ এবং বিমানঘাঁটি রয়েছে।
বিতর্কিত স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত ওই দ্বীপগুলোর মধ্যে কয়েকটি কৃত্রিম। অর্থাৎ, প্রবালপ্রাচীরকে ভিত্তি করে সেগুলো নির্মাণ করেছেন চীনা ফৌজের ইঞ্জিনিয়াররা। এমন দ্বীপের উপর এয়ারস্ট্রিপও বানিয়েছেন তারা। ঘটনাচক্রে, দক্ষিণ চীন সাগরের ওই অংশেই রয়েছে ‘গুপ্তধন’—প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেলের এক বিপুল ভাণ্ডার।
কৌশলগত ঘাঁটি’ বানিয়ে নৌ-আধিপত্য বজায় রাখতে বেইজিং তাই এতো তৎপর বলে মনে করেন কূটনীতিবিদদের একাংশ। প্রতিরক্ষা বিষয়ক পত্রিকা ‘আইএইচএস জেনস ডিফেন্স উইকলি’ প্রায় সাত বছর আগে দক্ষিণ চীন সাগরের কৃত্রিম দ্বীপে পিএলএর ঘাঁটি নির্মাণের কথা জানিয়েছিল।
ওয়াশিংটনের ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’ এ সংক্রান্ত উপগ্রহ ছবিও প্রকাশ করেছিল। দক্ষিণ চীন সাগরের পারাশেল দ্বীপপুঞ্জের উডি দ্বীপেও চীনা সেনারা বড় ঘাঁটি বানিয়েছে। তার অদূরে ফেয়ারি ক্রস রিফে গড়া হয়েছে দশ হাজার ফুট লম্বা একটি রানওয়ে। যাতে নামতে পারে চীনা বিমানবাহিনীর আধুনিক যুদ্ধবিমান।
দক্ষিণ চীন সাগরের ওই বিতর্কিত অঞ্চলকে ‘নিজেদের’ বলে দাবি করে ব্রুনেই, তাইওয়ান, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনামের মতো দেশও।
তাদের মোকাবিলার দায়িত্বে থাকা চীনা ফৌজের সাদার্ন থিয়েটার কমান্ড ওই ঘাঁটিগুলো বানিয়েছে। সেন্টার ফর দ্য নিউ আমেরিকার সিকিউরিটির গবেষক টম শোগার্ট সম্প্রতি জানান, ওই দ্বীপগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে চীন।
সামরিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের ধারণা, ওই গোপন দ্বীপের ঘাঁটিতে রয়েছে একাধিক চীনা গুপ্তচর জাহাজ। যাদের মাধ্যমে ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ানসহ একাধিক প্রতিবেশী দেশের উপর চলে নজরদারি। ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের কাছে এখন রয়েছে চীনা গুপ্তচর জাহাজ ইউয়ান ওয়াং-৬।
ভারত মহাসাগরে ঢুকে ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও)-র ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণের উপর নজরদারি করাই এর উদ্দেশ্য। আগামী ১০ বা ১১ নভেম্বর ওড়িশা উপকূলে আব্দুল কালাম দ্বীপ থেকে ২,২০০ কিলোমিটার পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করতে চলেছে ভারত। তার গতিবিধি ‘নজর’ করাই ইউয়ান ওয়াং-৬-এর এবারের ‘মিশন’।
নয়াদিল্লির আপত্তি উপেক্ষা করে অগস্টে চীনা নজরদারি জাহাজ ইউয়ান ওয়াং-৫ অগস্ট মাসের গোড়ায় শ্রীলঙ্কার হাম্বনটোটা বন্দরে ভিড়েছিল। ভারতীয় উপগ্রহের গতিবিধির উপর নজরদারি চালানোর কাজ করে ওই জাহাজটি।
আগামী দিনে চীন যে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি আগ্রাসী মনোভাব বজায় রেখেই চলবে, অক্টোবরে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম সম্মেলেনে সে দেশের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বক্তৃতাতেই তা স্পষ্ট হয়েছে গিয়েছে।
পিপলস লিবারেশন আর্মিকে আরও শক্তিশালী করার বার্তা দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, ২০৪৯ সালের মধ্যেই সামরিক শক্তিতে পশ্চিমি দুনিয়াকে পিছনে ফেলে দেবে চীন।
এসডব্লিউ/এসএস/১০০০
আপনার মতামত জানানঃ