ঢাকার সাভারে ডাকাতির শিকার এক পরিবারকে সহযোগিতা না করে উলটো নির্যাতন করেছে বলে ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। পরিবারটির অভিযোগ,সাভার ডিবি পুলিশ দোষীদের পিছনে না গিয়ে তাদের ফাঁসানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের দেড় লাখ টাকা দিতেও বাধ্য করেছে।
ঢাকার ধামরাই উপজেলার মাঝিপাড়া এলাকার ৬৮ বছর বয়সী কৃষক গদাধর মালোর পরিবার এ অভিযোগ করেছে।
দ্য ডেইলি স্টারের খবরে বলা হয়েছে, ডাকাতির পর তারা থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহযোগিতা না করে উলটো তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
গদাধর ১৮ জুন অজ্ঞাতনামা পাঁচ থেকে ছয়জনকে আসামি করে তার বাড়িতে ঢুকে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে ধামরাই থানায় একটি মামলা করেন। প্রায় এক মাস পর গোয়েন্দা পুলিশ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় এবং ৬ সেপ্টেম্বর অফিসাররা গদাধরের পুত্রবধূ শ্যামলী হালদার রুপা ও তার ১৪ বছরের ছেলে দিগন্ত হালদারকে ডিবি অফিসে যেতে বলেন।
৩৫ বছর বয়সী রূপা অভিযোগ করেন, তিনি এবং তার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে সেখানে গেলে অফিসাররা তাকে তিন দিন হেফাজতে রেখে নির্যাতন করে এবং তার ছেলেকে একদিন নির্যাতন করে।
মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুই সন্তানের মা ১৪ সেপ্টেম্বর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “ডিবি অফিসাররা আমাকে নির্দয়ভাবে মারধর করে এবং আমাকে বলতে বাধ্য করে যে, আমি ডাকাতিতে জড়িত ছিলাম।”
তিনি বলেন, “লম্বা দাড়িওয়ালা একজন অফিসার এবং একজন নারী অফিসার অন্যদের চেয়ে বেশি মেরেছে। তারা আমার ছেলেকে আমার সামনে মারধর করেছে। তাই তারা আমাকে যা বলতে বলেছিল আমি তাই বলেছি।”
পরে তিনি দাড়িওয়ালা অফিসারকে ইন্সপেক্টর ইয়াসিন মুন্সি হিসেবে চিনতে পারেন।
তিনি আরও জানান, ৯ সেপ্টেম্বর তার মুক্তির জন্য তার পরিবারের সদস্যদের ডিবি কর্মকর্তাদের দেড় লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।
ডাকাতির মামলা দায়েরকারী গদাধর গতকাল বলেন, “আমার পুত্রবধূ ও নাতিকে বিনা কারণে ডিবি অফিসে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই।”
গণমাধ্যম থেকে যোগাযোগ করা হলে ডাকাতি মামলার তদন্তকারী ঢাকা জেলা (উত্তর) ডিবির উপ-পরিদর্শক শেখ ফরিদ এবং পরিদর্শক ইয়াসিন মুন্সি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
ফরিদ বলেন, “রূপা নাটক করছে। পারিবারিক কলহের জের ধরে সে ডাকাতির আয়োজন করেছে।”
১৮ জুন ডাকাতির মামলা দায়েরের পর ধামরাই থানার উপ-পরিদর্শক আরাফাত উদ্দিনকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সম্প্রতি ঢাকার কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় বদলি হওয়া আরাফাত জানান, পুলিশ তখন সম্ভাব্য সন্দেহভাজন হিসেবে একজন স্থানীয় ব্যক্তিকে আটক করে এবং দুই দিন পর তাকে ছেড়ে দেয়।
গদাধরের ছোট ছেলে শ্যামল হালদার জানান, তিনি, রুপা, দিগন্ত ও কীর্তন হালদার নামে এক আত্মীয় গত ৬ সেপ্টেম্বর ডিবি অফিসে যান।
উপ-পরিদর্শক ফরিদ, পরিদর্শক কামাল হোসেন, একজন নারী কর্মকর্তা ও আরেক পুলিশ সদস্য রুপাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন।
শ্যামল বলেন, “তারা প্রায় ১২ ঘন্টা ধরে রুপা বৌদিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে।”
“আমরা ঠিক রুমের বাইরে বসে ছিলাম। ডিবি অফিসারদের ক্রমাগত গালিগালাজ করতে শুনেছি। দিগন্তকে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত না বললে মারধরের হুমকি দেয়। বৌদি জোরে চিৎকার করছিল।”
আমরা ঠিক রুমের বাইরে বসে ছিলাম। ডিবি অফিসারদের ক্রমাগত গালিগালাজ করতে শুনেছি। দিগন্তকে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত না বললে মারধরের হুমকি দেয়। বৌদি জোরে চিৎকার করছিল।
মধ্যরাতের দিকে ডিবি অফিসাররা রুপা ও দিগন্তকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে চত্বর ত্যাগ করে।
শ্যামল বলেন, “প্রচণ্ড অত্যাচারের কারণে বৌদি গাড়ির কাছে হেঁটে যেতেও পারেনি।”
কয়েক ঘণ্টা পর ধামরাইয়ের বোরোনালাই গ্রামের দুই স্কুলছাত্রসহ মাইক্রোবাসটি তাদের নিয়ে ফিরে আসে।
এরপর ডিবি অফিসাররা বৌদি ও দিগন্তকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে।
তিনি আরও জানান, ডিবি গত ৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে দিগন্ত ও দুই ছেলেকে ছেড়ে দেয় এবং রুপা ও কীর্তনকে আটকে রাখে।
শ্যামল বলেন, “৭ সেপ্টেম্বর রাতভর বারবার চেষ্টা করেও আমরা তাদের মুক্ত করতে পারিনি।”
৮ সেপ্টেম্বর, শ্যামল এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মোঃ আসাদুজ্জামানের সাথে দেখা করেন এবং তাকে কী ঘটছে তা জানান, তিনি বলেন।
আসাদুজ্জামানের পরামর্শে পরিবারটি ঢাকা জেলার অতিরিক্ত এসপি (ডিবি) মোবাশেরা হাবিব খানের সাথে দেখা করে।
শ্যামল বলেন, “মোবাশেরা ডিবি অফিসারদের রুপাকে নিয়ে তার অফিসে হাজির হতে বলেন। যখন তারা আসে মোবাশেরা বৌদিকে নির্যাতন করার জন্য ডিবি অফিসারদের বকাঝকা করেন।”
শ্যামল বলেন, “কিন্তু মোবাশেরা পরে রুপাকে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহার না করার জন্য বলেছিল। এই বলে যে সে যদি তা করে তবেই তাকে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে।”
ওইদিন রাতে ডিবি কর্মকর্তারা ডাকাতি মালামালের মূল্যমান করার নামে ধামরাইয়ে রূপার শ্বশুরবাড়ি ও মানিকগঞ্জের সিংগাইরে তার বাবার বাড়িতে অভিযান চালায়।
“তবে তারা কিছুই পায়নি,” শ্যামল বলেন। তবে ডিবি দল অভিযানের সময় রূপার আত্মীয় জীবনকে গ্রেপ্তার করে।
গত ৯ সেপ্টেম্বর শ্যামল তার বাবা গদাধর ও রূপার স্বামী কমল হালদারকে নিয়ে সাভার ডিবি কার্যালয়ে যান। ডিবি কর্মকর্তারা তাদের সবার কাছ থেকে ফাঁকা কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।
এরপর ডিবি অফিসাররা তাদের সবাইকে বলতে বাধ্য করে যে রুপাকে হেফাজতে নির্যাতন করা হয়নি এবং তাদের জবানবন্দির ভিডিও ধারণ করেছে বলে অভিযোগ করেন শ্যামল।
দুপুর দেড়টার দিকে ডিবি অফিস থেকে রুপাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরিবারের লোকজন তাকে চিকিৎসার জন্য মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে যায় বলে জানান তিনি।
তবে কীর্তন ও জীবনকে ১০ সেপ্টেম্বর কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানান শ্যামল। তিনি বলেন, “কীর্তনকেও পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছিল। তাকে ৪ অক্টোবর জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
ডিবির পরিদর্শক কামাল হোসেন জানান, কীর্তন ও জীবন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, রূপা ডাকাতির পরিকল্পনা করেছে।
তিনি দাবি করেন, রুপা ও তার ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কেউ তাদের নির্যাতন করেনি।
ঢাকা জেলার এসপি মোঃ আসাদুজ্জামানও নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, দুই অভিযুক্তের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে রুপাকে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে।
তিনি বলেন, “তাকে নির্যাতন করার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমি জানি না কেন তিনি এত দেরিতে নির্যাতনের অভিযোগ করছেন।”
আসাদুজ্জামান বলেন, “তিনি আমার কাছে আসতে পারতেন। তার অভিযোগ সত্য হলে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতাম।”
সম্প্রতি দেশে কনস্টেবল থেকে শুরু করে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এসব অপরাধ ও অপকর্মের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বে অবহেলা ও ঘুষ গ্রহণ ছাড়াও চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, এমনকি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার মতো ঘৃণ্য অপরাধও আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুলিশের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে এটা বলবো না৷ বলা উচিত এই প্রবণতা আগেও ছিল, এখনো আছে৷ আগে সেভাবে গণমাধ্যমে আসত না, এখন আসছে৷ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও আগে সেভাবে খেয়াল রাখত না, এখন রাখছে৷ ফলে বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।
তারা মনে করেন, পুলিশের মধ্যে কোন পরিবর্তন হয়নি৷ তাদের কিছু বিভাগ বেড়েছে সত্যি, কিন্তু সেই ব্রিটিশ নিয়মেই তারা চলে৷ আর এই সংস্কারটা হচ্ছে না এর কারণ পুলিশকে অনেক বেশি রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হয়৷ পুলিশের মধ্যে এমন কোন ক্যারিশমেটিক নেতা আসেনি যে তারা নিজের উদ্যোগেই সংস্কার করবে৷ আর আমাদের অর্থনীতি যেভাবে বেড়েছে তাতে পুলিশের মধ্যে এই দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে৷ অনেকেই অল্প দিনে ধনী হতে চান ফলে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন৷
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার হার আশংকাজনক। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে বিভিন্ন অপকর্মের। এবিষয়ে পুলিশের কর্তৃপক্ষসহ দেশের সরকাকেও নজর বাড়াতে হবে। কেননা, আইন রক্ষাকারী কর্তৃক একেরপর এক আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে দেশের আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা জন্মাবে। ফলে দেশে দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৩
আপনার মতামত জানানঃ