বিতর্ক আর ছাত্রলীগ যেন একই মায়ের পেটের ভাই। শাসক দলের ভ্রাতৃপ্রতীম এই সংগঠন দীর্ঘদিন ধরেই নানা অভিযোগে জর্জরিত। নির্বাচনের আগে সেই পালে লেগেছে হাওয়া। ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারি, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের বেদম পিটুনি নিয়ে ছাত্রলীগের সমালোচনা চলছে৷ অভিযোগ জানাচ্ছে ছাত্রলীগ নিজেই।
ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারির নেপথ্যে আছে সিট বাণিজ্য৷ নানা সূত্রের দাবি, কলেজের হোস্টেলে টাকার বিনিময়ে কক্ষ বরাদ্দই শুধু নয় অন্যান্য অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগও করেছেন খোদ কলেজেরই শিক্ষার্থীরা৷
এরপর ২৭ সেপ্টেম্বর ছাত্রদলের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সাথে দেখা করতে যাওয়ার পথে ক্যাম্পাসে তাদের বেদম মারপিট করা হয়৷ যদিও ভিসি তাদের দেখা করার জন্য সময় দিয়েছিলেন৷
এবার ইডেন কলেজের পর এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে চাকরিজীবী এক নেতা তার কক্ষে এসি লাগিয়ে আলোচনায় এসেছেন৷
সূত্র মতে, শনিবার বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবর ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷ এক চাকরিজীবী ছাত্রলীগ নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে তার রুমে এসি লাগিয়েছেন৷ চাকরিজীবীদের ছাত্রলীগের কমিটিতে থাকার সুযোগ না থাকলেও তিনি কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি৷
জানা গেছে, তিনি হলটির ৩১৩ নাম্বার কক্ষে থাকেন৷ সেখানে শুধু শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নয়, আছে রেফ্রিজারেটরও৷ শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনে সহকারী ব্যবস্থাপক পদে কর্মরত আছেন এই ছাত্রলীগ নেতা৷
এদিকে ছাত্রলীগের এমনসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে খোদ সংগঠনটির নেতারাই সমালোচনা করছেন৷ এ বিষয়ে তারা দলীয় নেতাদের কাছে অভিযোগ জমা দিয়েছেন বলেও জানান৷ আর সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য দাবি, অভিযোগ পেলে তদন্ত তরে তার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে৷
চোরের মায়ের লম্বা গলার মতো বিতর্কের তালিকা
এদিকে রাজশাহীতে ছাত্রলীগের সভাপতি পদে থাকা সাকিবুল ইসলাম সাবেক শিবির নেতা বলে অভিযোগ উঠেছে৷ তার বিরুদ্ধে নারীদের উত্যক্ত করার অডিও ভাইরাল হয়েছে৷ এই বিষয়ে এখন তদন্ত চলছে৷ অভিযোগ আছে নিয়ম অনুসরণ না করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাকে সভাপতি করা হয়েছে৷
গত ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ১৩ জন আহত হয়েছে৷ আহত হয়েছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য৷
যে অভিযোগ বেশি করে শোনা যাচ্ছে তা হলো ছাত্রলীগের পদ বাণিজ্য৷ ছাত্রলীগের ১২১টি ইউনিটের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৫২ টি ইউনিটের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ টাকার বিনিময়ে পদ দেয়ার যেমন অভিযোগ আছে, তেমনি পুরনো কমিটি ধরে রাখার অভিযোগও আছে৷
সিলেট জেলা ও মহানগর কমিটি দেয়া হয় প্রেস রিলিজের মাধ্যমে৷ এর বিরুদ্ধে সেখানে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন নেতা-কর্মীরা৷ তাদের অভিযোগ সাত মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি নাজমুল ইসলামকে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷
সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ ফেসবুক পোস্টে অভিযোগ করেছেন পদ নিয়ে বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছে৷
এছাড়া কক্সবাজার সমূদ্র সৈকতে এক নারীকে ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের’ অভিযোগের মূলহোতা আশিকুল ইসলাম আশিকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলে অভিযোগ আছে৷
১ জানুয়ারি ঘোষিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়৷ এই কমিটি নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে৷ সভাপতি ইব্রাহীম ফরাজীর বয়স ৩০ বছরের চেয়ে বেশি বলে অভিযোগ রয়েছে৷
যশোর জেলা কমিটির সভাপতি সালাউদ্দিন কবির পিয়াসের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও সেবনের অভিযোগ রয়েছে৷ ফেনসিডিলসহ একবার তিনি পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছেন৷
ওই কমিটির নয় জনের অধিকাংশের বিরুদ্ধে মামলা, বিবাহিত, অছাত্র ও মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে৷ ময়মনসিংহ জেলা সভাপতির দায়িত্ব পাওয়া মো. আল আমিন একজন অছাত্র৷
অভিযোগ করছে ছাত্রলীগ নিজেই
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি কামাল খান অভিযোগ করেন, ‘‘ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় কমিটির মতামত না নিয়ে কমিটি গঠন করায় ছাত্রলীগ বিতর্কিত হচ্ছে৷ আমরা অভিযোগ পাই লেনদেনের মাধ্যমে প্রেস রিলিজ দিয়ে কমিটি দেয়া হয়৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ আমাদের অভিভাবকদের কাছে অভিযোগ দিয়েছি৷ আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে অভিযোগের ব্যাপারে প্রতিকার পাবো৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এই কারণেই এখন ছাত্রলীগের কমিটিতে, অছাত্র, বিবাহিত, বিতর্কিতরা জায়গা পাচ্ছে৷ তারাই নানা অঘটন ঘটাচ্ছে৷’’
তবে পদ বাণিজ্যসহ এইসব অভিযোগ অস্বীকার করেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য৷
তিনি দাবি করেন, ‘‘নিয়ম মেনে, গঠনতন্ত্র মেনেই কমিটি দেয়া হচ্ছে৷ তারপরও রাজশাহীতে যে বিতর্ক উঠেছে তা আমরা তদন্ত করছি৷ একজনের নৈতিক স্খলনের দায় তো সংগঠন নেবে না৷’’
ইডেন কলেজের ঘটনার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘এটা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে অন্য পদের কিছু নেত্রী অবস্থান নিতে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে যাতে পুরো কলেজের তারা বদনাম করেছে৷ এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি৷ আরো তদন্ত হচ্ছে৷’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের ওপরে হামলা ঘটনাটিকে তিনি প্রতিরোধ হিসবে ব্যাখ্যা করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এর আগে যখন তারা ক্যাম্পাসে বক্তৃতা দিয়ে ৭৫-এর ঘটনা ফের ঘটানোর হুমকি দিয়েছে৷ তারপর ওই দিন তারা লাঠি হাতে এসেছে৷ তাদের এই আচরণে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ ছিলো৷ তাই তাদের প্রতিরোধ করা হয়েছে৷’’
তার কথা, ‘‘ছাত্রলীগে অছাত্র, বিবাহিত বা চাকরিজীবীদের কোনো জায়গা নেই৷ জহুরুল হক হলে যারা রুমে এসি লাগানোর কথা বলা হচ্ছে তিনি চাকরি পাওয়ার পরই ছাত্রলীগে আর নেই৷ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অটোমেটিক তার পদ শূণ্য হয়ে গেছে৷ তবে হলে এসি লাগানোর ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি৷ এটা সম্ভবও না৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘ছাত্রলীগের কোনো নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিই৷’’
চোখে কাপড় বেঁধে আছে আ’লীগ
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ছাত্রলীগ বেপরোয়া ও লাগামহীন হয়ে পড়েছে। দেশের সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতা-কর্মী সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদকের কারবারসহ বেপরোয়া অগ্নিকান্ডসাধারণ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত ও অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃশংস খুন-খারাবি, অগ্নিকান্ড, পিটিয়ে মিক্ষার্থী হত্যা, ছাত্রী ও নারী ধর্ষণের মত অসংখ্য অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়েছে ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতা-কর্মী। হেন কোনো অপকর্ম নেই সংগঠনটির বিরুদ্ধে উঠছে না। কিন্তু এখনও অব্দি কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি আওয়ামী লীগ। তারা যেন চোখে কাপড় বেঁধে আছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, আওয়ামী লীগ নেতারা মুখ খুলুন বা না খুলুন, বালুতে মুখ গুঁজে রাখলেও ঝড় থামানো যাবে না। সমাজের একটি বড় অংশে ছাত্রলীগের কারণে আওয়ামী লীগের প্রতি একধরনের বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে। আমরা মনে করি, ছাত্রলীগ এখন আওয়ামী লীগের গায়ে একটি বড় বিষফোড়া। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেক সংকটের সঙ্গে এটি একটি বড় ফাঁড়া হয়ে দেখা দেবে বলে আমরা মনে করি।
তাদের উচিত ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান প্রমাণের চেষ্টা করা ২০০১-এর মতো সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ না করার দুর্ভাগ্য যেন আর বরণ করতে না হয়! কিন্তু মনে জোর পাচ্ছি না-বিগত কদিন ধরে দেশের সর্বত্র ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ ইতিহাসের পুনরাবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে কি না-এটাই প্রশ্ন।
একই সময় তিনি বলেন,২০০১-এর জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্বাচনপূর্ব সরকার ছিল আওয়ামী লীগ। শাসনকালের শেষদিকে অনেকটা ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিল দলটি বা সরকার। দেশজুড়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাস সাধারণ মানুষকে বিরক্ত করে তুলেছিল। বিশেষ করে কয়েকটি জেলায় কয়েকজন রাজনৈতিক মাস্তান-নেতা গডফাদার হিসাবে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু এদের প্রতিহত করার বদলে প্রশ্রয় দিয়েছে সরকার ও দল। যারা আওয়ামী লীগের বরাবরের সমর্থক, তাদের অনেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা দেখেছি কতটা বড় মূল্য দিতে হয়েছিল দলটিকে। ক্ষমতা হারিয়েছিল আওয়ামী লীগ।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ