সম্প্রতি কক্সবাজারের কয়েকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশ উত্তেজনা চলছে। ঠিক এই সময়ে উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৪ মাঝিকে (নেতা) খুনের দায় স্বীকার করে রোহিঙ্গা যুবকের ভিডিও বার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। কীভাবে, কার ইন্ধনে খুন করেছেন তার বর্ণনা দিলেন মো. হাসিম (২১) নামের ওই রোহিঙ্গা যুবক।
গত ১ মাসে ৪ নেতা খুনের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও আকারে প্রকাশ করেন হাসিম।
ভিডিওতে দেখা যায়, একটি অস্ত্র হাতে কোন ক্যাম্পের কোন মাঝিকে কীভাবে হত্যা করেন তার বর্ণনা দিচ্ছেন মো. হাসিম।
ভিডিওতে বলেন, তার মতো ২৫ জন যুবককে অস্ত্র দিয়ে ইসলামী সংগঠন ‘মাহাজ’ সৃষ্টি করেছে ক্যাম্পের কতিপয় ব্যক্তি।
তিনি বলেন, “আমাদের মোটা অংকের টাকা দিয়ে হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করা হতো।”
খুনের শিকার মাঝিদের নামও বলেছেন এই যুবক। তারা হলেন ১৮নং ক্যাম্পের হেড মাঝি জাফর, ৭নং ক্যাম্পের ইসমাঈল, কুতুপালং এক্সটেনশন ক্যাম্প-৪ এইচ ব্লকের এরশাদ ও হেড মাঝি আজিমুল্লাহ।
ভিডিও বার্তায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ ইসলামী সংগঠন ‘মাহাজ’র ৪ মুখপাত্রের নামও বলেন ওই যুবক। তারা হলেন জিম্মাদার শাহাব উদ্দিন, রহমত উল্লাহ, হেড মাঝি ভূঁইয়া, মৌলভী রফিক, কাদের, খাইরুল। এরা এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিতেন বলে জানান তিনি।
আমাদের মোটা অংকের টাকা দিয়ে হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করা হতো।
রোহিঙ্গা যুবক আরও জানান, তাদের সামনে আরও বড় মিশন ছিল। কিন্তু সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। তাই এই খারাপ জগত ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চান।
এদিকে মোহাম্মদ হাশিমের সেই লাইভ ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এই ভিডিও প্রচারের পর থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাঝিসহ নেতৃস্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
গোয়েন্দা সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ইসলামী মাহাজ নামে সংগঠনটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানা অপকর্ম করে। তারা ক্যাম্পে বড় ধরনের নাশকতা করে। তাদের আটকের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘ভিডিওতে ওই রোহিঙ্গা যুবক যাদের নাম উল্লেখ করেছেন, তদন্ত সাপেক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ক্যাম্পের নিরাপত্তার জন্য আমরা সব সময় সজাগ রয়েছি।’
গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বর্তমানে চারটি জঙ্গি সংগঠন তৎপরতা চালাচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে পুরনো দুই জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসলামী মাহাজ এবং জমিউয়তুল মুজাহিদীন নামে নতুন দুই সংগঠন।
৩২টি শরণার্থী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে ২৭টিতে রয়েছে আরসার আধিপত্য। এ সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন সৌদি আরবে বেড়ে ওঠা পাকিস্তানি নাগরিক আবু আম্মর জুনুনী ওরফে আতাউল্লাহ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রত্যেক ব্লকে রয়েছে এ সংগঠনের তৎপরতা। এ সংগঠন ‘ওলামা কাউন্সিল’, ‘ওলামা বোর্ড’, ‘মজলিসে আম’ এবং ‘আরকান আরমট’ এ পাঁচ শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্পগুলোতে তৎপরতা চালাচ্ছে।
আরসা ভেঙে নতুন আরেকটি গ্রুপ তৈরি করেছেন মুন্না নামে এক নেতা। আতাউল্লাহর এক সময়ের সহযোগী মুন্না আরসা থেকে বের হয়ে তৎপরতা চালাচ্ছেন ক্যাম্পের কিছু কিছু ব্লকে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপর রয়েছে ইসলামী মাহাজ নামে আরেকটি সংগঠন। পাঁচ শরণার্থী ক্যাম্পে রয়েছে নতুন সংগঠনটির তৎপরতা। এ সংগঠনের নেপথ্যে রয়েছেন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বার্মার কয়েকজন নেতা। এ সংগঠনের আমির শেখ সালামত নামে এক ব্যক্তি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপর আরেক জঙ্গি সংগঠন ‘আরএসও’র নেতৃত্বে রয়েছেন দুই পাকিস্তানি নাগরিক হাফেজ সালাহুল ইসলাম এবং মাওলানা মোহাম্মদ আতাউল্লাহ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এ সংগঠনটি ফের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। জমিউয়তুল মুজাহিদীন নামে আরেকটি জঙ্গি সংগঠন তৎপরতা শুরু করেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এ সংগঠনটির নেপথ্যে রয়েছেন মাওলানা হানিফ রাগেব নামে এক ব্যক্তি।
এ চার জঙ্গি সংগঠনের অর্থায়ন হয় সৌদি আরব, আরব আমিরাত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। মূলত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপর বিভিন্ন এনজিও, হুন্ডির মাধ্যমে এসব দেশ থেকে আসা টাকা সংগঠনগুলোর কাছে পৌঁছানো হয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘সরকারের উচিত মাথাচাড়া দেওয়ার আগে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। নইলে এসব সংগঠন বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এখনও কঠোর অবস্থান না নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে নানা ধরনের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতা, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর উস্কানি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর ইতোমধ্যেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আসতে শুরু করেছে। এসব অপতৎপরতা দীর্ঘমেয়াদে এই অঞ্চলের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।
তারা আরও বলেন, এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে আরও বেশি গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনা এবং তাদের প্রত্যাবাসনে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩১
আপনার মতামত জানানঃ