বিশ্বে চলছে সোশ্যাল মিডিয়ার রাজত্ব। যুগের চাহিদায় দিন দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। ফেসবুক ছাড়া এখন ভাবাই অসম্ভব। কী নেই এখানে? চাইলেই সবকিছু মেলে নেট দুনিয়ায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ফেসবুক। ভুয়া তথ্য প্রচার, অশালীন মন্তব্য ও ঘৃণা ছড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এ মাধ্যম। এ ছাড়া ফেসবুকের বিরুদ্ধে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদে সমর্থন ও পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেছেন বিশ্বের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। মানুষকে বিপথগামী করতে রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি।
মিয়ানমারে গণহত্যায় উসকানিতে ফেসবুক ব্যবহার করা হলেও তা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের (ইউএনএইচআরসি) তদন্তদলের প্রধান গত সোমবার বলেছেন, ফেসবুক মিয়ানমারের লাখ লাখ উপকরণ হস্তান্তর করেছে, যা যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার অভিযোগকে সমর্থন করতে পারে।
ইউএনএইচআরসি ২০১৮ সালে মিয়ানমারে ইনডিপেনডেন্ট ইনভেস্টিগেটিভ মেকানিজম ফর মিয়ানমার (আইআইএমএম) নামের একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে। এর প্রধান নিকোলাস কমজিয়ান। তিনি বলেন, ফেসবুক বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের নেটওয়ার্ক থেকে লাখো উপকরণ হস্তান্তর করেছে। এসব তথ্য ও উপকরণ ফেসবুকের পক্ষে সাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। কারণ, এসব উপকরণ অ্যাকাউন্টের পরিচিতিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।
মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর ঘটনায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
২০১৮ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার এক তদন্তের তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমারে ঘৃণামূলক বক্তব্য ও অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরিতে ফেসবুক মূল ভূমিকা পালন করছে। একই সময়ে রয়টার্সের এক তদন্তে দেখা যায়, এক হাজারের বেশি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে রোহিঙ্গা ও মুসলিমদের বিকৃত ভাষায় কটাক্ষ করা হয়। এমনকি তাদের গুলি করে হত্যার অনুরোধও করা হয়। ফেসবুক জানায়, সে সময় তাদের ভুয়া তথ্য এবং ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য ও কনটেন্ট প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনেকটা ধীরগতিতে চলছিল।
ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে গাম্বিয়া ২০১৯ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজেতে গণহত্যার মামলা করে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের আগস্টে জাতিগত নিধন শুরু হলে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রায় ১২ লাখ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গাম্বিয়া গণহত্যা সনদের আওতায় মিয়ানমারর বিরুদ্ধে আইসিজেতে ওই মামলা করেছিল।
২০২১ সালে ফেসবুক (বর্তমান নাম মেটা) জানায়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জবাবদিহির জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে তারা। ওই বছরেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ফেসবুকের বিরুদ্ধে ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করে। মামলায় বলা হয়, ফেসবুক ঘৃণাত্মক বক্তব্য ছড়াতে ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিপজ্জনক ভুয়া তথ্য ছড়াতে সহায়তা করেছে।
যারা মনে করে তাদের আইনের মুখোমুখি হতে হবে না, এমন মানুষের জবাবদিহির অভাবেই মিয়ানমারের জনগণ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
রয়টার্সকে দেওয়া এক বিবৃতিতে মেটার মানবাধিকার নীতির পরিচালক মিরান্ডা সিসনস বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘের অনুসন্ধানী ব্যবস্থায় স্বেচ্ছায়, আইন মেনে তথ্য প্রকাশের পাশাপাশি গণহত্যার মামলা করা গাম্বিয়ার কাছে জনসাধারণের তথ্য প্রকাশ করেছি।’
গত সোমবার আইআইএমএম প্রধান কমজিয়ান বলেন, প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নেওয়া প্রত্যেক রোহিঙ্গা সেই দিনের অপেক্ষায় রয়েছে, যখন তারা নিরাপদে মর্যাদার সঙ্গে দেশে ফিরতে পারবে। যারা সহিংসতা উসকে দিয়েছে, তাদের দায়মুক্তি বন্ধ হলে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। যারা মনে করে তাদের আইনের মুখোমুখি হতে হবে না, এমন মানুষের জবাবদিহির অভাবেই মিয়ানমারের জনগণ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
ইউএনএইচআরসি প্রধান, আইআইএমএম বিচারক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের জন্য ৬৭টি প্রমাণমূলক এবং বিশ্লেষণাত্মক প্যাকেজ তৈরি করেছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের কার্যক্রমও যুক্ত রয়েছে। এখন পর্যন্ত ২০০টি সূত্র থেকে ৩০ লাখের বেশি তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ করা হয়েছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে মিয়ানমারের ৫ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ মানুষের কাছে ইন্টারনেট ছিল। কিন্তু মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে ২০১৬ সালে মিয়ানমারে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৪০ লাখ।
রোহিঙ্গা গণহত্যায় ফেসবুকের ভূমিকা সুপ্রতিষ্ঠিত। ২০১৮ সালে ফেসবুকের নিয়োগকৃত একটি কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিতে এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে। ওই বছরের আগস্টে ফেসবুক মিয়ানমারে ২০ টি সংগঠন ও ব্যক্তিকে নিষিদ্ধ করে। এদের মধ্যে একজন সামরিক কমান্ডারও রয়েছেন।
২০১৭ সালে একটি রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলার পর সেনাবাহিনী পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি নির্মূল অভিযান চালায়। ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে যায় এবং নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে গণধর্ষণ,হত্যা ও হাজার হাজার বাড়িতে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়।
গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারি কর্মকর্তাদের জেলে বন্দি করে জোরপূর্বক দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সেনাদখলের নিন্দা জানিয়ে বলে, এর ফলে মিয়ানমারে ফিরে যেতে তারা আরও ভয় পাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫১
আপনার মতামত জানানঃ