দেশের সুপার শপগুলোতে ‘অতি মুনাফা’ ও বিভিন্ন ধরনের ‘অনিয়ম’ চিহ্নিত করে ক্রেতারা প্রতি পদক্ষেপে ‘প্রতারিত হচ্ছেন’ বলে জানিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গতকাল মঙ্গলবার কারওয়ান বাজারে সুপার শপগুলোর ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে এসব নিয়ে কাজ করার কথা বলেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।
এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে স্বপ্ন, মিনাবাজার, আগোরা, প্রিন্সবাজার, ইউনিমার্টসহ ঢাকার বিভিন্ন সুপার শপের বিপণন কেন্দ্র পরিদর্শন করেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এসময় অতি মুনাফা, অন্যায্য ঘোষণাসহ ভোক্তা স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়। বৈঠকে চাল, চিনি, লবণ, ডিম, ইলিশ মাছসহ বিভিন্ন পণ্যে অতিমুনাফার তথ্য তুলে ধরেন কর্মকর্তারা।
ভয়াবহ অভিযোগ
তারা জানান, সুপার শপগুলোতে ডিমে ১৮ থেকে ২২ শতাংশ, চালে ১৩ থেকে ২৯ শতাংশ, লবণে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করতে দেখা গেছে।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, “কয়েকদিন আগে ডিমে কারসাজি ও অতিমুনাফার আড়ালে ভোক্তার পকেট থেকে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা চলে গিয়েছিল। সুপার শপগুলোতে যে এমআরপি (সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য) লেখা হয়, সেখানে লাভের পরিমাণ অনেক বেশি। তারাও সেটা স্বীকার করেছেন। কে এর জন্য দায়ী সেজন্য আমরা এখনই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না।”
সুপার শপ মালিক আর পণ সরবরাহকারীরা পরস্পরকে দুষছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “সাপ্লাইয়াররা সুপার শপ মালিকদের দিকে আঙ্গুল তুলেছিল। এখন এরা বলছেন যে, সাপ্লাইয়াররা দাম লিখে দেয়। আমিও জানতাম যে, আপনারা (সুপার শপ মালিক) আজকে এসে এসবই বলবেন। বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার। কারণ এখানে ভোক্তার স্বার্থ জড়িত। ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত টাকা চলে যাচ্ছে।”
সফিকুজ্জামান বলেন, “প্রিমিয়াম চালের নামে প্রতি কেজি চাল ৮২ টাকা করে বিক্রি করছে তারা। এসব চাল বাজারে ৫৪ থেকে ৫৮ টাকায়ও বিক্রি হয়। আমাদের কাছে তথ্য আছে, মিনিকেট নামে যেসব চাল, সেগুলো মোটা চাল ছাঁটাই করে তৈরি করা।”
তিনি বলেন, “ভোক্তা যখন বাজারে যায়, সে প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতারিত হচ্ছে। প্রতারণার ছক তারা যেভাবে সাজিয়ে রেখেছে, সেই জায়গাগুলোতে আমাদের কাজ করতে হবে।”
এসব নিয়ে আগামী সপ্তাহে পণ্যের উৎপাদক, ভেন্ডর ও সরবরাহকারীদের নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করার কথা জানান জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
বৈঠকে সুপার শপের পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগীর প্রসঙ্গ তুলে ধরেন নাগরিক সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) অনলাইন প্রকাশনা ভোক্তাকণ্ঠের সম্পাদক কাজী আব্দুল হান্নান।
তিনি বলেন, “খাদ্যপণ্যে সরকার নির্ধারিত কতগুলো ধাপ আছে। সেখানে কোথাও ‘ভেন্ডর’ নেই। ভেন্ডরের লাইসেন্স কৃষি অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কেউ দেয় না। তাহলে এ ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী কারা? যারা দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। চেইন শপগুলোতে দেখা যায়, ভেন্ডররা দাম ঠিক করছে। এরা আসলে কারা?”
ভোক্তার হাতে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন অনিয়ম হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, “তারা ২৫ থেকে ২৯ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করছে ভেন্ডর থেকে আউটলেটে ক্রেতার হাতে পণ্য তুলে দিতে গিয়ে। তাহলে উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত আসতে কত শতাংশ মার্জিন যুক্ত হচ্ছে? সেটা যৌক্তিক কি না? রাষ্ট্র এখান থেকে লাভবান হচ্ছে কি না? এখানে বড় ধরনের অনিয়ম হচ্ছে।”
চালের বাজার অস্থির হওয়ার প্রসঙ্গে ভোক্তাকণ্ঠের সম্পাদক আব্দুল হান্নান প্রশ্ন তুলে বলেন, “চালের বাজার কেন আজকে এই পর্যায়ে গেল? দুইটা প্রবণতা এখানে। প্রথমত চালের ব্যবসার সাথে কৃষকের সম্পর্ক নেই। মিলাররা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের কেউ কেউ এই চাল প্যাকেজিং কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করে।”
তিনি জানান, এ ধরনের ১৭টি প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া গেছে যাদের মধ্যে ৮টি প্রতিষ্ঠান মিলের সঙ্গে যুক্ত। বাকিরা মিল থেকে চাল কিনে নিজেরা প্যাকেজিং করে, নিজেদের নামে বিপণন করে।
“তাদের নামকাওয়াস্তে মিল আছে, কিন্তু সেটা মোট মার্কেটিংয়ের ১০ শতাংশও নয়।”
ভোক্তাকণ্ঠের সম্পাদক বলেন, “এই ধরনের কোম্পানিগুলো অটোমিলারদের কাছ থেকে অগ্রিম বুকিং দিয়ে পণ্য কিনে নেওয়ার কারণে বাজারে এক ধরনের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। পাইকারি বাজারে ঘাটতি হচ্ছে।”
প্যাকেজিংয়ে যুক্তরা সুবিধাজনক সময়ে আগাম চাল কেনে দাবি করে তিনি বলেন, “বাজারে যখন সংকট তৈরি হয় বা করা হয়, তখন সরকার বাধ্য হয় শুল্ক হ্রাস করতে। সেই অনুমতির সময় এই চালটা আসে।
“তখন ট্যারিফ দেখানো হয় বর্তমান বাজার মূল্যে। এভাবে বড় ধরনের একটা বেনিফিট বাজার থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা এটাকে বলি লুণ্ঠনমূলক মুনাফা। এখানে চেইন শপের একটা ভূমিকা রয়েছে। আপনি আউটলেট। আপনি কিনবেন হচ্ছে পাইকারি বাজার থেকে। সেখানে আপনি ভেন্ডরের অজুহাত দিয়ে নতুন ব্র্যান্ড তৈরি করছেন। ভোক্তা অধিকারকে এখানে কাজ করতে হবে।”
বৈঠকে ডেইলি শপিংয়ের প্রতিনিধি ফিরোজ আলম, প্রিন্স বাজারের তাজুল ইসলাম খান ও উত্তম কুমার বাগচী, স্বপ্নের মালিক প্রতিষ্ঠান এসিআই লজিস্টিকসের ইমরান হাসান ও তামিম খান, আগোরা লিমিটেডের আব্দুস সবুর, ইউনিমার্টের নাজমুল হুদা ও ইবরিয়াদ হাসান উপস্থিত ছিলেন।
কী বলছে সুপার শপ প্রতিনিধিরা?
বেশি দাম নিয়ে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, তারা ‘প্রিমিয়াম’ পণ্য বিক্রি করেন, সেকারণে দামটাও ‘প্রিমিয়াম’ হচ্ছে। ভাল মান ও ভাল সেবা নিশ্চিত করতে তাদের পরিচালন ব্যয় অন্যদের চেয়ে বেশি থাকে। এছাড়া বাজার ‘প্রমোশনের’ জন্য প্রতি মাসেই কিছু কিছু পণ্যে ছাড় দিয়ে থাকেন বলেও দাবি তাদের।
সুপার শপ স্বপ্নের প্রতিনিধি তামিম খান বলেন, “আমরা প্যাকেজিংয়ের কাজটি করি না। সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো এটা করে এবং তারাই দামটা ঠিক করে দেয়।
“আমরা কাস্টমারদের জন্য ব্যাপারগুলো ওপেন রেখেছি। কেনা, না কেনা এটা তাদের ব্যাপার। এখন চাহিদা আছে বিধায় জিনিসগুলো এভাবে দাঁড়াচ্ছে।”
ডেইলি শপিংয়ের প্রতিনিধি ফিরোজ আলম বলেন, “আমাদের প্যাকেটের গায়ে একটা মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দেওয়া থাকে। সেই তারিখ অতিক্রম করে ফেললে জিনিসগুলো কিন্তু ওয়েস্টেজ হিসেবে ফেলে দিতে হয়। এভাবে আমাদের কিছু ডেমারেজ দিতে হয় এবং সেটাও হিসাব করতে হচ্ছে।”
প্রিন্স বাজারের তাজুল ইসলাম খান বলেন, “ক্রেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে যেসব প্রচারাভিযান ও অনুষ্ঠানগুলো আমরা করে থাকি তাতেও ১৮ থেকে ২০ শতাংশ খরচ হয়। এসব কারণে এত লাভ না করলে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়।”
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ