ধর্মীয় উগ্রবাদে জড়িয়ে কথিত জিহাদের নামে আবারও ঘর ছেড়েছেন কুমিল্লার ৭ তরুণ। এসব তরুণ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘হিজরত’ করেছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে।
কুমিল্লার তরুণদের আগে সিলেট অঞ্চল থেকেও কিছু তরুণ একই জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে বাড়ি ছেড়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে জানা গেছে।
জানা যায়, গত ২৩ আগস্ট কোচিংয়ে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে যান সাতজনের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। যাওয়ার সময় তেমন টাকাপয়সা, মোবাইল ফোন কিংবা বাড়তি পোশাকও নেননি তারা। একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলেও নিখোঁজ প্রত্যেকেই ছিলেন পরস্পরের পরিচিত। তাদের বয়স ১৭ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।
তাদের মধ্যে ইমতিয়াজ আহম্মেদ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
নিখোঁজ নিহাল আবদুল্লাহ কুমিল্লা সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। কুমিল্লা শহরের অশোকতলায় তার বাসা। তার মা ফৌজিয়া ইয়াসমিন ২৫ আগস্ট থানায় জিডি করেন।
আমিনুল ইসলাম ওরফে আল আমিন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইসলাম শিক্ষা চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।
নিখোঁজ আমিনুলের বাবা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমিনুল আমার বড় ছেলে। সে আগে তাবলিগের নেতাদের সঙ্গে চিল্লায় যেত। পড়াশোনার পাশাপাশি কান্দিরপাড়ে আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বসতো। ছেলে খুঁজে না পেয়ে হতাশ আমি।’
সরতাজ ইসলাম ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছেন। ইমরান বিন রহমান ওরফে শিথিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র। বাসা কুমিল্লা শহরে। তার বাবা মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ২৪ আগস্ট থানায় জিডি করেন।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিথিল আমার একমাত্র ছেলে। সে কোচিংয়ে যাওয়ার কথা বলে ২৩ আগস্ট বিকেল চারটায় বের হয়। এরপর বলেছিল রেসকোর্স নুর মসজিদে তাবলিগের বয়ান শুনবে। এরপর আর বাসায় ফেরেনি।’
নিখোঁজদের পরিবার সূত্রে জানা যায়, তারা খুব ধর্মভীরু। সবাই বাবা-মার বাধ্য সন্তান। পড়াশোনার বাইরে অন্য বিষয়ের প্রতি তাদের আগ্রহ দেখা যায়নি। কলেজ, কোচিং এর বাইরে বাসায় বসে তা ধর্মীয় বই পড়া কিংবা মোবাইল ফোনে ওয়াজ ও ধর্মীয় নানা আলোচনা শুনে তাদের সময় কাটতো।
কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ সহিদুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, নিখোঁজ তরুণদের বিষয়ে পুলিশ অনুসন্ধান করছে। পুলিশ জানতে পেরেছে বাড়ি ছাড়ার পর ওই তরুণেরা কুমিল্লা থেকে চাঁদপুরে যায়। এরপর চাঁদপুর রেলস্টেশন এলাকার একটি হোটেলে রাতে ছিল। পরদিন সকাল সাড়ে ছয়টায় তারা ওই হোটেল থেকে চলে যান। এরপর থেকে তাদের আর হদিস মেলেনি।
জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে এটা পরিষ্কার যে এসব তরুণ জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েই বাড়ি ছেড়েছেন। বিষয়টি তারা গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন।
তারা খুব ধর্মভীরু। সবাই বাবা-মার বাধ্য সন্তান। পড়াশোনার বাইরে অন্য বিষয়ের প্রতি তাদের আগ্রহ দেখা যায়নি। কলেজ, কোচিং এর বাইরে বাসায় বসে তা ধর্মীয় বই পড়া কিংবা মোবাইল ফোনে ওয়াজ ও ধর্মীয় নানা আলোচনা শুনে তাদের সময় কাটতো।
হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ছয় বছর পর আবারও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণদের ঘর ছাড়ার প্রবণতাকে উদ্বেগজনক মনে করছেন জঙ্গিবাদবিষয়ক বিশ্লেষক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কারণ, হোলি আর্টিজান হামলায় জড়িত জঙ্গিরাও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এভাবে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন।
তবে হোলি আর্টিজানের হামলার আগে যারা বাড়ি ছেড়েছিলেন, তারা ছিলেন মূলত নব্য জেএমবির সদস্য। যারা নিজেদের আইএস (ইসলামিক স্টেট) দাবি করতেন। আর এবার নিখোঁজ তরুণেরা আনসার আল ইসলামের সদস্য, যারা নিজেদের আইকিউআইএসের (আল–কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশীয় শাখা) বাংলাদেশ শাখা দাবি করে।
২০১৪–১৬ সালে যেসব তরুণ বাড়ি ছেড়েছিলেন, তারা মূলত সিরিয়ায় আইএসের পক্ষে লড়াই করার লক্ষ্যে বের হয়েছিলেন। তাদের একটি অংশ সিরিয়ায় গেলেও বাকিদের দেশের ভেতরেই বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় রেখে প্রশিক্ষণ দেয় নব্য জেএমবি। তখন এসব তরুণের সামনে ‘হিজরতের’ নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করান জঙ্গি নেতারা। বলা হয়, দেশের ভেতরেও এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় গেলে সেটা ‘হিজরত’ হিসেবে গণ্য হবে।
সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়া তরুণরাও আফগানিস্তানে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে বাড়ি ছাড়েন বলে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। জঙ্গি দমনে কাজ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নতুন করে নিখোঁজ এই তরুণদেরও দেশের ভেতরে কোনো না কোনো আস্তানায় রেখে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন।
বাংলাদেশে গড়ে ওঠা সহিংস জঙ্গি সংগঠনগুলো মতবাদ ছড়িয়ে ঘর থেকে, মায়ের আঁচল ছিঁড়ে ছেলেমেয়েদের বের করে নিচ্ছে। বলছে, জঙ্গিদের হিংস্র রাস্তাই নাকি জিহাদের রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে গুলি-বন্দুক-কিরিচ-কুড়াল-বোমা, টাইমবোম, ছুরি-দা নিয়ে হাটলে পাকাপোক্ত বেহেস্ত পাওয়া যাবে। মানুষ খুন করা নাকি আল্লাহর রাস্তা। যেখানে আত্মহত্যা মহাপাপ, সেখানে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নির্দোষ মানুষ বিনা কারণে হত্যা করে যাচ্ছে জঙ্গিরা, তারা ‘জিহাদ’ শব্দটির অপব্যবহার করছে। এসব জিঘাংসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে নারী, শিশু। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী জিহাদের নেশায় ঘর ছাড়ছে, বিপথগামী হচ্ছে। মানুষ হত্যার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এরা বিজ্ঞানের এবং প্রযুক্তির অপব্যবহার করছে। লোকালয়ের বাইরে জঙ্গি আস্তানাগুলোতে বসে বসে পড়ছে তথাকথিত জিহাদী বই। আর দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করছে অস্ত্র। যে অস্ত্র কোনো অপরাধীর বুকে নয় আগাত হানা হবে নিরপরাধের বুকে।
গুলশানের হলি আর্টিজান হোটেটে নিরপরাধ ২৪ জন আদম সন্তান হাসতে হাসতে তলোয়ার দিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় জবাই করার সময়ও ধর্মের দোহাই পাড়া হয়েছিলো।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের কিছু ধর্মান্ধগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক। ২০ বছর আগে যখন তালিবানের রমরমা অবস্থা ছিল, তখন এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্তানে গিয়ে তালিবানে যোগ দিয়েছিল। একই সঙ্গে ঢাকার বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে স্লোগান দিয়ে বলেছিল, ‘বাংলা হবে আফগান, আমরা হব তালিবান’। তালিবান ফের আফগান মসনদে আসায় বাংলাদেশের ওই ধর্মান্ধগোষ্ঠী বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে— এমনই আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। কাজেই আফগান নিয়ে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থানে থাকতে হবে পরামর্শ তাদের।
তারা বলেন, এদেশ থেকে তথাকথিত মুজাহিদীনদের আফগানিস্তানে গিয়ে তালিবানদের পক্ষে যুদ্ধ করার তথ্য-প্রমাণ আমরা পেয়েছি। দেশে ফিরে তারা শুধু হরকাতুল জিহাদ বা হুজির মতো জঙ্গি সংগঠনই সৃষ্টি করেনি, দেশের প্রগতিশীল রাজনীতিকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়েছে। রাজনৈতিক মিত্র বেছে নিয়ে কৌশলে নিজেদের সংগঠনের প্রসার ঘটিয়েছে, সেই তালিবানি চ্যানেলেই অর্থ পেয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আফগানিস্তানে তালিবানরা ক্ষমতায় আসার পর এ দেশের উগ্র মতাদর্শী তরুণদের মধ্যে একধরনের মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়। আল–কায়েদার শীর্ষ নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি মারা যাওয়ার পর আল–কায়েদা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার যে চেষ্টা করছে, তাতে উগ্রবাদী এই তরুণেরা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন বলে মনে হয়। এই অস্থিরতার কারণে তরুণদের মধ্যে নতুন করে হিজরতের প্রবণতা তৈরি হয়ে থাকতে পারে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, তালিবান পুনরুত্থানের জায়গাতে আমরা দেখছি যে আমাদের দেশের জঙ্গিদের একটি অংশ আফগানিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেখান থেকে সহযোগিতা বা পৃষ্টপোষকতা নিয়ে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদকে আবার উজ্জীবিত করা যায় কিনা। তো এখানে যেমন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হবে, তেমনি আমাদের আঞ্চলিক যে ভূ-রাজনীতি আছে, সেটাকেও প্রভাবিত করার জন্য এ শক্তিকে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হবে। সেটি বাংলাদেশের জন্য একটি শঙ্কার কারণ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ