ক্রমেই মাদকের অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে সৌদি আরব। চলতি বছরের এপ্রিলে এক ঘটনার খবরে সচকিত হয়ে দেশটির গণমাধ্যম। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির পূর্ব প্রদেশের এক ব্যক্তি ইফতারের ঠিক আগে নিজের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। এতে ওই পরিবারের চার সদস্য মারা যান।
পুলিশের বরাত দিয়ে স্থানীয় পত্রিকা জানিয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি ‘শাবু’ বা ‘মেথাফেটামিন’ নামে একটি মাদকের ঘোরে ছিলেন।
সিএনএন বলছে, সৌদিতে মাদকের ব্যবহার বেড়ে গেছে, এই নিয়ে ইদানিং সৌদি গণমাধ্যমগুলোতে শঙ্কার খবর আসছে। একজন কলামিস্ট দেশটিতে মাদকের চালান সম্পর্কে বলেছেন, এটি আমাদের বিরুদ্ধে খোলা যুদ্ধের শামিল, যেকোনো যুদ্ধের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক।
সম্প্রতি সৌদিতে চার কোটি ৭০ লাখ অ্যাম্ফিটামিন ট্যাবলেট পাচারের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে দেশটির কর্মকর্তারা। সংবাদ সংস্থা জাস্ট আর্থের এক প্রতিবেদনে এটিকে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় মাদক পাচার অভিযান হিসেবে বলা হয়েছে। এ ঘটনায় ওই মাদকসহ ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বুধবার (৩১ আগস্ট) অভিযান চালিয়ে দুই পাকিস্তানি ও ছয় সিরিয়ার নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়।
সৌদি প্রেস এজেন্সির বরাত দিয়ে জিও টিভি জানিয়েছে, ময়দার চালানে লুকানো অ্যাম্ফিটামিন ট্যাবলেটগুলো জব্দ করা হয়। ওই ট্যাবলেটগুলো রিয়াদের একটি বন্দরে পৌঁছায়। এরপর সেখান থেকে একটি গুদামে নিয়ে যাওয়া হয়।
সৌদি জেনারেল ডিরেক্টরেট অব নারকোটিক্স কন্ট্রোলের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ‘সৌদি আরবে এটি সবচেয়ে বড় মাদক পাচার। একইসঙ্গে এটি ছিলো সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় মাদক পাচার অভিযান। তবে ট্যাবলেটগুলো ক্যাপ্টাগন ছিলো কিনা তা ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
এই রেকর্ড পরিমাণ মাদক জব্দের বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকের চালান এভাবে বাড়তে থাকায় মধ্যপ্রাচ্যের মাদকের রাজধানী হয়ে উঠেছে সৌদি আরব। মাদকের চাহিদা বাড়তে থাকায় দেশটি সিরিয়া ও লেবাননের চোরাকারবারীদের প্রাথমিক গন্তব্য হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, মাদকের জন্য সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে লাভজনক আঞ্চলিক গন্তব্যগুলির মধ্যে একটি হয়ে উঠছে সৌদি এবং দিন দিন তা আরও বেড়েই যাচ্ছে।
সৌদির জেনারেল ডিরেক্টরেট অব নারকোটিকস কন্ট্রোল জানায়, বুধবারের অভিযানে মাদকের জব্দ করার পরিমাণ বিচারে সেদিনের চালানের প্রচেষ্টা ছিল এককভাবে সবচেয়ে বড়।
তবে দেশটির কর্তৃপক্ষ, জব্দ করা মাদকের নাম কী এবং কোথায় থেকে এসেছে সে সম্পর্কে কিছু জানায়নি। তবে এর আগে ইউনাইটেড ন্যাশন্স অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি)বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অ্যামফেটামিন জব্দ করার যেসব খবর আসছে তাতে ক্যাপ্টাগন লোগো যুক্ত বড়ি সম্পর্কেই বেশি ইঙ্গিত মিলেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ক্যাপ্টাগন’ মূলত উত্তেজক ফেনিথিলাইনযুক্ত একটি ওষুধি পণ্যের ব্র্যান্ড। সিনএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি ও এর পাশের অঞ্চলগুলোতে মাদক উদ্ধার অভিযানে ‘ক্যাপ্টাগন’ বড়ি জব্দ করার পরিমাণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে।
আরবের সবচেয়ে ধনী এই রাষ্ট্রটিতে ক্যাপটাগন পিল এখন এক নতুন উন্মাদনা। মন ফুরফুরে করার জন্য মাদকসেবীরা এটি গ্রহণ করেন। মূলত এটি আমাদের দেশের বহুল পরিচিত ইয়াবারই আরেকটি রূপ। এই পিল গ্রহণ করলে সহজে ঘুম আসে না এবং মানুষের মাঝে উন্মাদনারও সৃষ্টি করে। সবশেষে এটি স্বাস্থ্যেরও বড় ক্ষতি করে।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে যত ক্যাপটাগন পিল উদ্ধার হয়েছে তার অর্ধেকেরও বেশি হয়েছে সৌদি আরব থেকে।
সিরিয়ার সংকট শুরু হলে মধ্যপ্রাচ্যে ক্যাপটাগন খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মূলত বিভিন্ন পক্ষে যুদ্ধরত সৈন্যরাই এই পিল গ্রহণ করতে শুরু করেন, যেন দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ করা যায়।
পরে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের সরকার ও তার পক্ষের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর জাতিসংঘ বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও ক্যাপটাগন মাদকের ব্যবসা তার নিজস্ব ছায়া অর্থনীতি তৈরি করে নিয়েছে।
অভিযোগ আছে, এই মাদক পাচারের সঙ্গে সিরিয়ার সরকারের গভীর সংযোগ রয়েছে। মোটা অঙ্কের অর্থ পেয়ে থাকে বলেই সিরিয়ার সরকার এই ব্যবসা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। সিরিয়া ছাড়াও লেবাননের যেসব অঞ্চল ইরানপন্থি হিজবুল্লাহ গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণে, সেসব এলাকায়ই ক্যাপটাগন পিল ব্যাপক পরিসরে উৎপাদন করা হয়।
আরবে ক্যাপটাগনের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে এই মাদকের ব্যবহার বাড়লেও দেশটিতে তা কোনোভাবেই গাঁজা ও খাট মাদকের চাহিদা কমাতে পারেনি।
সৌদি আরবে গাঁজা প্রবেশ করার বেশ কয়েকটি পথ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত পথটি হলো আফগানিস্তান থেকে প্রথমে ইরানে প্রবেশ করে বিপুল পরিমাণ গাঁজা। পরে এই গাঁজা ইরাক হয়ে সৌদি আরবে প্রবেশ করে। এ ছাড়া লেবানন, সিরিয়া ও জর্ডান হয়েও গাঁজা প্রবেশ করানো হয় দেশটিতে।
ইয়েমেন হয়েও সৌদি আরবে গাঁজা প্রবেশ করছে। আর খাট নামের মাদকের প্রায় সব চালানই ইয়েমেন থেকে সৌদি আরবে প্রবেশ করে। চতুর্দশ শতকে এই মাদকটি সুফি-সাধকরা গ্রহণ করতেন বলে ইয়েমেনে এর একটি সামাজিক স্বীকৃতিও রয়েছে।
সৌদি সরকার আশঙ্কা করছে, এসব মাদক থেকে সুবিধা পাচ্ছে এই রাজতন্ত্রের বিরোধী সামারিক শক্তি ও সংগঠনগুলো। বলা হচ্ছে, দেশটিতে সব ধরনের মাদক পাচারের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গেরিলারা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সৌদি আরবে ১২ থেকে ২২ বছর বয়সীদের মধ্যে মাদকের ব্যবহার বাড়ছে। আর দেশটিতে যারা মাদক সেবন করেন, তাদের ৪০ শতাংশই ক্যাপটাগন পিল গ্রহণ করেন।
এসডব্লিউ/১৯০৩
আপনার মতামত জানানঃ