সংঘাতের পথে চলে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, অন্যতম মাঠের দল বিএনপিসহ প্রভাবশালী দলগুলো আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কেউ মাঠ ছাড়বে না। মাঠ দখলের টার্গেট সবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা না দেয়ার নির্দেশনা দিলেও কেউ তা মানছে না। রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে ঘটছে নিহতের ঘটনা। পুলিশ, সাংবাদিক, বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদলের বহু নেতা আহত ও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
অনেকেই বলছেন, চীন ইস্যু, তিস্তা ইস্যু, রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র আগামী দ্বাদশ নির্বাচনের আগে পরিবেশ আরও খারাপ হতে পারে। দেশের উত্তপ্ত রাজনীতির জন্য হতে পারে নানা ষড়যন্ত্র। এর মধ্যে থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য অতিউৎসাহী হয়ে যেতে পারে। যা সরকারের জন্য বিপদ নিয়ে আসতে পারে বলে মনে করছে গোয়েন্দা সংস্থা।
তারা বলছে, রাজনৈতিক উত্তপ্ত পরিবেশ চলমান সরকার কোনোভাবেই চাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অতিউৎসাহী সদস্য পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করছে। বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আচরণও সহনশীল নয় বলেই দৃশ্যমান হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও মারমুখী লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা বিরোধী দলকে দাঁড়াতেই দেবে না, এমন ঘোষণা অনেকের। মনোনয়ন পেতে স্থানীয় রাজনীতিতে শক্তি প্রদর্শন চূড়ান্তভাবে দেখানো হচ্ছে।
এবার বিএনপিও ছাড় না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অল্প কিছুতেই কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে মাঠে নামিয়ে একটি সহিংস পরিস্থিতি ঘটিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ ফায়দা নিতে পারে বলেও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
নির্বাচনের আগে কোনো ধরনের সহিংসতা কাম্য নয় উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, প্রতিটি পলিটিক্যাল পার্টিকে সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু সরকার জায়গা দেবে না। ওরা (বিরোধী) জোর করে নিবে। একজন আরেকজনকে জায়গা দিবে না । তা তো হয় না। এতে সংঘাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কোনো ধরনের সহিংসতা কাম্য নয়। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের এখনো অনেক সময় বাকি আছে।
তবে এখন নারায়ণগঞ্জে বিএনপির সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পর আতঙ্ক বিরাজ করছে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী যখন বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়েছেন ঠিক সেই সময় সারাদেশে বিএনপির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের সহিংসতার খবর রাজনীতির জন্য এক অশনি সংকেত বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের সহিংসতায় দুইজন মারা গেছেন। এ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে উত্তেজনা বিরাজ করছে। অন্যান্য এলাকাতেও ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়েছে। এর ফলে রাজনীতিতে এক ধরনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও সহিংস রূপে আবির্ভূত হবে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন এবং এখানে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের একটি ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
বিএনপিকে মাঠে দাঁড়াতে দিচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। হঠাৎ করেই যেন রাজপথ সহিংস হয়ে উঠেছে। গত তিনদিন ধরে সারাদেশে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। আর এ সব সংঘর্ষে কয়েক শতাধিক আহতের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিন থেকেই এই সংঘর্ষ ঘটছে।
এছাড়া প্রায় ৬ হাজার ব্যক্তিকে অজ্ঞাতনামা দেখিয়ে মামলা হওয়ায় গ্রেপ্তার এড়াতে বিএনপির অনেকেই সতর্ক অবস্থানে চলে গেছেন। যাদের নামে মামলা করা হয়েছে এবং যাদের নাম আসেনি—সবাই নিজ বসতবাড়ি থেকে সরে থাকছেন বলে জানান নেতা-কর্মীরা।
নারায়ণগঞ্জ শহরে পুলিশ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে ভুক্তভোগী শাওনের পরিবার ও পুলিশের করা মামলায় প্রায় ৬ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় ৫ হাজার অজ্ঞাতনামা এবং আরেকটি মামলায় ৭১ জনের নাম উল্লেখ করে বাকি ৯০০ ব্যক্তিকে অজ্ঞাতনামা আসামি দেখানো হয়েছে।
মামলা দুটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) আমীর খসরু। তিনি জানান, পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার অভিযোগ এনে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সদর মডেল থানায় দ্বিতীয় মামলাটি করা হয়েছে। এর আগে, শাওনের বড় ভাই বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার একটি মামলা করেন। ওই মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। সেই মামলায় কাউকে দায়ী করা হয়নি।
মামলা দুটির বাদী হলেন, নিহতের ভাই মিলন হোসেন ও চাষাঢ়া পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক কামরুজ্জামান।পুলিশের করা ভাঙচুরের মামলায় নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবি, সদস্যসচিব মামুন মাহমুদ, যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ হাসান রোজেল, মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর সবুর খান সেন্টু, সহসভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান ও আতাউর রহমান মুকুল, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আল ইউসুফ খান টিপু, জেলা যুবদলের সদস্যসচিব মশিউর রহমান রনি, মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি শাহেদ আহমেদসহ ৭১ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে।
ইতিমধ্যে পুলিশের করা মামলায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে শুক্রবার আদালতে পাঠানো হয়। সেখানে জামিন আবেদন করলে আদালত তাঁদের জামিন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠান। পুলিশ এই মামলায় আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত রোববার (আজ) রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করেন।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন আব্দুস সাত্তার (২২), মজিবুর রহমান (৫২), রঞ্জন কুমার দেবনাথ (৩৬), রাজিব (৩৮), জনি (৩৮), বাদল (৩৩), আবুল কালাম ভূঁইয়া (৪৮), রিমন (২২), ইমন (১৮) ও সোহান (১৮)।
বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে আদালত পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান বলেন, নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় করা মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। আজ তাঁদের বিরুদ্ধে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
পুলিশের করা মামলায় অভিযোগ আনা হয় নামীয় ৭১ আসামিসহ আরও ৮০০ থেকে ৯০০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। নেতা-কর্মীরা পুলিশের দায়িত্বে বাধা, হামলা, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ এবং অগ্নিসংযোগ করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়। অন্যদিকে নিহত শাওনের ভাইয়ের করা মামলায় অভিযোগ আনা হয়, বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ চলার সময় সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন শাওন। সেখানে অবৈধ অস্ত্রের গুলি এবং ইটের আঘাতেই মৃত্যুবরণ করেন শাওন।
গতকাল শনিবার বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নামীয় আসামিরা আজ থেকেই উচ্চ আদালতে আগাম জামিনের আবেদন শুরু করবেন। তবে শাওন হত্যা মামলায় সব আসামিকে অজ্ঞাতনামা দেখানোর কারণে এই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় জেঁকে ধরেছে নেতা-কর্মীদের। ফলে সহসাই নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রকাশ্যে মিছিল, মিটিং বা সভা-সমাবেশ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
১ সেপ্টেম্বর সংঘর্ষের পর থেকেই থমথমে পরিবেশ বিরাজ করে নারায়ণগঞ্জ শহরজুড়ে। শাওনের বাড়িতে বিএনপির মহাসচিবের আগমন এবং একই সঙ্গে পরিবারের সদস্যের মামলা করার বিষয়টি ছিল আলোচনায়।
দুটি মামলা দায়ের এবং সংঘর্ষ-পরবর্তী বিএনপির অবস্থানের বিষয়ে জেলা বিএনপির সদস্য রুহুল আমিন শিকদার বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীরা হরতাল পালন করতে চেয়েছিল। কিন্তু দলের মহাসচিব কর্মীদের জীবনরক্ষার কথা চিন্তা করে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা দিয়েছেন। এটা সত্য যে মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি রাখায় সাধারণ নেতা-কর্মীদের ধরে নিয়ে মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় কি-না, সেই আতঙ্ক রয়েছে। আমরা মনে করি, বিগত দিনে গায়েবি মামলার মতোই এবার অজ্ঞাতনামা আসামি করে হয়রানির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আমরা কোনোভাবেই দমে যাব না। শাওনের মৃত্যুর শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে আরও সংঘবদ্ধ হবে বিএনপি।’
জেলা বিএনপির এক সদস্য নাম গোপন রাখার শর্তে আজকের পত্রিকা বলেন, দুটি মামলা দায়েরের পর কিছুটা সরে থাকার নির্দেশনা এসেছে ওপর থেকে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে কোনো কর্মসূচি প্রকাশ্যে পালন করবেন না বিএনপির নেতা-কর্মীরা। সবার আগে গ্রেপ্তার এড়িয়ে থাকতে হবে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে দল।
মামলার বিষয়ে যুবদলের এক নেতা বলেন, আজ থেকে উচ্চ আদালতে জামিন নেওয়ার চেষ্টা করবেন মামলার নামীয় আসামিরা। এরাই মূলত দলের প্রধান চালিকাশক্তি। দলকে নেতৃত্ব দিয়ে সুসংগঠিত করছেন তারা। ধারাবাহিক জামিনের পরেও আগামী দিনের প্রতিটি কর্মসূচিতে বাধা আসবে এই আশঙ্কা সামনে রেখেই নিজেদের কর্মসূচি নিয়ে ভাবছেন নেতারা।
মূলত, জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে গত ২২ আগস্ট থেকে ঢাকার বাইরে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করছে বিএনপি। এরপর থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মারমুখী অবস্থানে দেখা গেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১৮
আপনার মতামত জানানঃ