কারা হেফাজতে গত আগস্টে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে ৬২টি রাজনৈতিক সহিংসতা ও একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংস ঘটনায় ৪ জন নিহত হন।
মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) আগস্টের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতীয় দৈনিকগুলোয় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এমএসএফ এ প্রতিবেদন তৈরি করে বলে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই স্থানীয় মানবাধিকারকর্মীদের মাধ্যমে যাচাই করা হয়েছে।
এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মাসে কারা হেফাজতে মৃত্যু এর আগের মাসের চেয়ে বেশি। ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটার হারও অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ নাগরিকদের বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন চিন্তা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
এমএসএফ বলছে, পুলিশ অথবা কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার দায় অবশ্যই রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়। গত মাসে কারা হেফাজতে যে আট মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে একজন হাজতিকে নির্যাতনের পর কারাগারে পাঠালে অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। হেফাজতে থাকা বাক্প্রতিবন্ধী এক তরুণী আত্মহত্যা করেছেন। বিনা অপরাধে কারাগারে একজন প্রতিবন্ধীকে আটকে রাখা আইন সম্মত নয়।
কারাগারের অভ্যন্তরে হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন ও বিনা অপরাধে কারাগারে একজন প্রতিবন্ধীকে আটকে রাখার ঘটনাগুলো উদ্বেগজনক ও সঠিকভাবে তদন্তের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
এমএসএফ বলছে, আগস্টে ৫৩৪টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এ সংখ্যা জুলাইয়ের তুলনায় ১৮০টি বেশি। এ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৬৬টি, দলবদ্ধ ধর্ষণ ২৪টি, ধর্ষণ ও হত্যা ২টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে তিনজন প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোরী, চারজন প্রতিবন্ধী নারী এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার দুজন প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরী।
ধর্ষণের শিকার ৬৬ জনের মধ্যে ১৪ শিশু ও ২৬ কিশোরী রয়েছে। অন্যদিকে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে আটজন কিশোরী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার একজন শিশু ও একজন কিশোরী।
সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে যেভাবে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং তাদের যেভাবে শারীরিকভাবে আক্রমণ, হয়রানি, হুমকি ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বরং বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার কণ্ঠ রোধ করার শামিল।
আগস্টে দেশের বিভিন্ন জেলাতে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে ৬২টি রাজনৈতিক সহিংসতা ও একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংস ঘটনায় চারজন নিহত হন। সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৭৯৯ জন, যাদের মধ্যে আহত হয়েছেন ৭২২ জন, ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত ও ৪৩ জনকে আটক করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন বিএনপির কর্মী, দুজন আওয়ামী লীগের ও ইউপি নির্বাচনের দ্বন্দ্বে একজনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে।
স্বাধীন সাংবাদিকতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় আগস্টে ৩৮টি ঘটনায় সাংবাদিকেরা নানাভাবে হুমকি, হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এমএসএফ বলছে, সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে যেভাবে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং তাদের যেভাবে শারীরিকভাবে আক্রমণ, হয়রানি, হুমকি ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বরং বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার কণ্ঠ রোধ করার শামিল।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে ৩৮টি ঘটনায় ১৪ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন এবং ১ জন নারী সাংবাদিকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আক্রমণের শিকার হয়েছেন ৩ জন সাংবাদিক, লাঞ্ছিত হয়েছেন ৬ জন, পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধাগ্রস্ত হয়ে নানাভাবে হুমকির শিকার হয়েছেন ১৪ জন সাংবাদিক।
বাংলাদেশের আইন বলছে, ‘হেফাজতে মৃত্যু’ বেআইনি কাজ, অপরাধ। তারপরও এর বিচার হয় না। ২০১৩ সালের আইনে এ পর্যন্ত বিচার হয়েছে একটি।
হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার বিচার হয় না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার অভিযোগও করে না। পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা নেওয়ার উদাহরণ বিরল বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। কিন্তু অভিযোগ না করেও পরিবারের যেসব অভিজ্ঞতা তা জানলেই বোঝা যায়, কেন কারও পক্ষে অভিযোগ করার সাহস দেখানো সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ নিজেরাই তদন্ত করে, ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, যে পুলিশ মামলাই নিতে চায় না, তার হাতে তদন্তের ভার দিলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কারণ নেই। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য কোনো স্বাধীন কমিশন গঠনের ইচ্ছা বা আগ্রহ যে সরকারের নেই, তা-ও সহজেই বোধগম্য।
তারা আরও বলেন, পুলিশের কর্মকর্তারা একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছেন, যেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল করে দেওয়া হয়। এই দাবি একেবারে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে এমন নয়। তদুপরি, পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতে এই বাহিনীর সদস্যরা যে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বেই ভাববেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই; হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা সেগুলো প্রতিদিন প্রমাণ করে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু নিয়ে তারা বলেন, আধিপত্য বিস্তার, প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা ও আদর্শবর্জিত রাজনীতির চর্চার কারণেই অভ্যন্তরীণ সংঘাত বেড়ে যাচ্ছে। নিজ রাজনৈতিক দলের ভেতরে এ প্রতিযোগিতা চলবে। যেহেতু রাজনীতিটা আদর্শবিহীন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জবাবদিহিতা নাই, স্বচ্ছতা নাই। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও এগুলো নাই। এ কারণেই সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৪
আপনার মতামত জানানঃ