মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে গুম ও নিখোঁজের ঘটনা রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। গুম ও নিখোঁজের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি বিপদগ্রস্ত করছে বলেও মনে করে সংগঠনটি।
এমএসএফের এক বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের নাগরিকের জীবন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রধানতম দায়িত্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে গুম ও নিখোঁজের ঘটনা অবশ্যই সংবিধানের পরিপন্থী। বাংলাদেশ যেসব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছে সেগুলোরও পরিপন্থী। গুম ও নিখোঁজের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি বিপদগ্রস্ত করছে। গুম হওয়া পরিবারগুলো, সন্তানেরা প্রতি মুহূর্তে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। গুম ও নিখোঁজ হওয়া মানুষ ফিরে আসবেন, গুমের একটি ঘটনাও আর ঘটবে না, সেটাই সবার কাম্য।
যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে, তা যতই গুরুতর হোক, আমরা লক্ষ করেছি, অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে গেছে। তাকে অবশ্যই আইনের কাছে সোপর্দ করতে হবে। কারণ, প্রত্যেক ব্যক্তির আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার তাঁর সাংবিধানিক অধিকার।
শুধু তাই নয়, গুম নিয়ে চাপে হাসিনা সরকার। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিচেল ব্যাচেলেটের সফরের সময় চারদিন ধরে বার বার সরকারের নেতাদের তার মুখ থেকে বিচার-বহির্ভূত হত্যা এবং বহু মানুষের লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার অভিযোগ নতুন করে শুনতে হয়েছে। তাদেরকে সে সব অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে, খণ্ডন করতে হয়েছে।
মিজ ব্যাচেলেট ঢাকায় যেদিন নামেন সেদিনেই পরপর সরকারের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী; স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র এবং আইন মন্ত্রীর সাথে দেখা করে গুম, খুন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জেরে সাংবাদিক হয়রানি নিয়ে তার উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। বুধবার ফিরে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেও তিনি এসব বিষয় তোলেন।
এবার আবারও একই বিষয়ে বিব্রত সরকার। গুমের শিকার সব নিখোঁজ ব্যক্তিকে দ্রুত খুঁজে বের করে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
আজ মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। এ উপলক্ষে আজ সোমবার দেওয়া এক বিবৃতিতে সরকারের কাছে আসক এ আহ্বান জানায়।
আসকের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বারবার বলপূর্বক অন্তর্ধান বা গুমের ঘটনা অস্বীকার করা হয়েছে।
তবে বিভিন্ন সময়ে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, সাংবাদিক বা মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুসন্ধানে গুমের সুস্পষ্ট অভিযোগ উঠে এসেছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে তুলে নেওয়ার কিছুদিন পর গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলেও গণমাধ্যমে সংবাদ বেরিয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২২ (২৯ আগস্ট) পর্যন্ত ২৮ জন গুমের শিকার হয়েছেন বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনেরা অভিযোগ তুলেছেন। তাঁদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ১২ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫ জন ফেরত এসেছেন। অন্য ব্যক্তিরা এখনো নিখোঁজ।
সোমবার দেওয়া বিবৃতিতে আসক সরকারের কাছে ছয়টি দাবি জানায়। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি তারা গুম-সংক্রান্ত অভিযোগের একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি করে।
এ ছাড়া গুমের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন, দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের সম্মুখীন করে তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, গুম-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করা এবং এ ধরনের ঘটনার বিচার নিশ্চিতে আইনকাঠামোতে পরিবর্তন আনার দাবি করে।
আসক সোমবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে তিনটি সুনির্দিষ্ট দাবি করে। সেগুলো হলো গুমের ঘটনগুলোর অভিযোগগুলোর তথ্যানুসন্ধান, ভুক্তভোগী বা তাঁদের পরিবারকে আইনি ও নৈতিক সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলো অভিযোগ নিয়ে একটি জাতীয় শুনানির আয়োজন করা।
এদিকে, গত ২০ আগস্ট এ পর্যন্ত যারা গুম হয়েছেন, তাদের বিষয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। মায়ের ডাক সংগঠনের ব্যানারে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে এ দাবি জানায় নিখোঁজদের পরিবার। দ্রুত স্বজনদের কাছে তাদের প্রিয়জনদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবিও জানানো হয়।
গুমের শিকার পরিবারের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে মানববন্ধনে যোগ দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও। এ সময় বক্তারা গুমের বিষয়টি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানান।
এ সময় গুমের শিকার বাবাকে একনজর দেখার আকুতি জানায় ছোট্ট আবিদা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, বান্ধবীরা যখন বলে তোমার বাবা কী করে? তখন কোনো উত্তর দিতে পারি না।
২০১৩ সালে আবিদার বাবা যখন নিখোঁজ হন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২ বছর। এরপর বাবার পরশ ছাড়াই আবিদার বেড়ে ওঠা।
শুধু আবিদাই নয়, তার মতো একই আকুতি ছিল মানববন্ধনে আসা সাফার কন্ঠেও, মাত্র ২ মাস বয়সেই পিত্রস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় সেও। এখনও মেলেনি প্রিয় বাবার খোঁজ।
মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল বলেন, এজন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আপনাদের ভাবমূর্তি লুণ্ঠিত হচ্ছে। আপনাদেরকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, কেন তাদের খুঁজে পান না।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বাংলাদেশে এখন যে দুঃসময় যাচ্ছে, গত ৫২ বছরে এত খারাপ সময় কখনো আসেনি।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাষ্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, মায়ের ডাকের, তাদের কাছে ক্ষমা চান। তাদের সব ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন-স্বামীকে ফেরত দিন। আপনি যদি না জেনে থাকেন, তাহলে জেনে নিন।
এসডব্লিউ/এসএস/০৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ